Sunday, April 21, 2019

দুই বিদুষী হটি বিদ্যালঙ্কার ও রুপমঞ্জরী
                   ফিরোজ আলি কাঞ্চন

       অষ্টাদশ -উনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থা ছিল বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ,কৌলিণ্য প্রথা এমনকি সতীদাহ প্রথার মতো নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষণশীল এই সমাজে নারী জাতি ছিল প্রচণ্ডভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত,ছিল না কোন ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সামাজিক মর্যাদা।আর এমতাবস্থায় সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যদিয়েও নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভায় নিজস্ব স্বতন্ত্রতার পরিচয় রেখেছিলেন যে কয়েকজন বজ্ঞীয় রমণী তাঁদের মধ্যে অন্যতমা  যে দুজনা তাঁরা হলেন রাঢ়দেশীয় হটি বিদ্যালঙ্কার ও কুমারী রুপমঞ্জরী দাস; এছাড়া অনান্যরা হলেন পূর্ববঙ্গের বিক্রম পুরের আনন্দময়ী দেবী ও কোটালী পাড়ার বৈজয়ন্তী দেবী।
            হটি বিদ্যালঙ্কার 
          -------------------------
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পূর্ব বর্ধমান জেলার সোঁয়াই গ্রামে এক কুলীন ব্রাম্ভণ পরিবারে হটি বিদ্যালঙ্কারের জন্ম।হটি বিদ্যালঙ্কারের প্রকৃত নাম সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না।বাড়িতে পিতার শাস্ত্র চর্চা দেখে ছেলেবেলায় তিনিও বায়না ধরলেন পড়াশুনা শিখবেন।কিন্তু সে সময়।টোল-চতুস্পাঠীতে মেয়েদের পড়াশুনার প্রচলন ছিল না,তবুও কন্যার জেদে পিতা বাড়িতেই হটিকে ব্যাকরণ, কাব্য ও শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠদান শিখালেন।
     কিন্তু এ পাঠদান বেশিদিন বজায় থাকলো না,মেয়ের বয়স যে বেড়ে চলেছে,স্বভাবতই হটির হয়েগেল বাল্যবিবাহ পার্শবর্তী গ্রামে এক তরুণ পণ্ডিতের সঙ্গে।পিতা যেন হটির জন্য এমন এক পাত্র নির্বাচন করলেন যে তাঁর কন্যার সুপ্ত বাসনাগুলিকে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে।বিবাহের পর তরুণ পণ্ডিত স্বামীর কাছে অনেক রাত্রি পর্যন্ত মগ্ন থাকতেন শাস্ত্রচর্চায়,স্বামীকে বলতেন,' দেখবে তোমাদের মতো আমিও পণ্ডিত হব।'
      এ ধারাও বেশিদিন টিকল না,হঠাৎ ঘটল স্বামীর অকাল প্র‍য়াণ,পিতাও গত হয়েছেন।স্বামী পিতাকে হাড়িয়ে হটি পরিণত হল নিঃসঙ্গ,একাকিনী এক বাল্য বিধবায়।হতাশার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জীবনে বাঁচার রসদ হিসেবে তিনি বেছে নিলেন তাঁর সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবায়িত করার উগ্র ইচ্ছেকে-যে করেই হোক তাঁকে শাস্ত্রজ্ঞ হতেই হবে,শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যাদানে দেশ-বিদেশে বিখ্যাত হয়ে সে যেন স্বর্গীয় স্বামী ও পিতার প্রতি চরম শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করবে।সাহস আর আত্মবিশ্বাসে ভর করে হটি পৌঁছালেন তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র অধ্যায়ণ ও অধ্যাপনার কেন্দ্র কাশীতে।সেখানের বিখ্যাত বিখ্যাত সব পণ্ডিতদের চতুষ্পাঠীতে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে একাগ্র চিত্তে কঠিন অধ্যায়ন করে তিনি আয়ত্ব করলেন জ্যোতিষ বিদ্যা,ন্যায়শাস্ত্র,গণিত,ছন্দোসূত্র প্রভৃতির পাঠ।কাশীর পণ্ডিত সমাজ একজন নারীর এই অসামান্য পাণ্ডিত্য ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এক সম্বর্দ্ধনা সভার আয়োজন করে হটিকে ' বিদ্যালঙ্কার ' উপাধিতে ভূষিত করলেন।হটি বিদ্যালংকার কাশীতে এক চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অধ্যাপনা করতে থাকেন।১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে কাশীধামে এই এই শাস্ত্রজ্ঞ বিদূষী মহিলা পরোলোক গমণ করেন।
            রুপমঞ্জরী দাস
          ------------------------
          অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে আনুমানিক ১৭৭৫খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে পূর্ব বর্ধমানের বুদবুদ থানা অঞ্চলের কোটা গ্রামে এক বৈষ্ণব পরিবারে পণ্ডিত কুমারী রুপমঞ্জরী দাসের জন্ম।মাতা সুধামুখী দেবীর অকাল মৃত্যুতে মাতৃহারা রুপমঞ্জরী ছিলেন পিতা নারায়ণ দাসের কাছে বড়োই আদরের।কন্যার সব চাহিদা পূরণ করার তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন।ছেলেবেলা থেকেই রুপমঞ্জরীর মনে আসত অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন!  যার সব উত্তর  পিতা দিতে পারতো না,যেমন রুপমঞ্জরী জিজ্ঞেস করলো,' আমাদের সমাজে শুধু ছেলেরায় মুণ্ডিত মস্তকে টিকি রাখে,মেয়েরা রাখেনা কেন বাবা?আমিও মাথা মুণ্ডিত করে টিকি রাখবো।'নারায়ণ দাস কন্যার কৌতুহলী প্রশ্নের যুক্তিযুক্ত কোন উত্তর দেতে পারলেন না,তবে কন্যার প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন।মুণ্ডিত মস্তকে একগুচ্ছ টিকিরেখে ধূতি চাদর পরিধান করে ছোট্ট রুপমঞ্জরী যখন পিতার হাত ধরে পথে বেরুতো তখন প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখতো।কিন্তু আরো একটু বড়ো হয়ে রুপ মঞ্জরী যখন বায়না ধরলো সে টোলে ভর্তি হয়ে শাস্ত্র অধ্যায়ন করতে চায় তখন তা যেন পিতাকে বড়োই বিড়াম্বনায় ফেলে।দিল,তবুও কন্যার জেদকে দমালো না।রুপমঞ্জরীর মুণ্ডিত মস্তক আর পোশাক দেখে পণ্ডিত মশায় তো অবাক! তবে তিনি ছোট্ট শিক্ষার্থীনীকে সাদরে গ্রহণ করলেন।
            বিধি যেন বাম।রুপমঞ্জরী যখন পনেরো ষোল বছর বয়স তখন।পিতার মৃত্যু তাঁর জীবনে আনলো চরম আঘাত। মাতাকে সে আগেই হাড়িয়েছে,এবার নারায়ণ দাসের মৃত্যু তাকে করেদিল আরো অসহায়।তবে এই হতাশময় জীবনে রুপমঞ্জরী ভেঙে পড়লেন না,আবার শুরু করলেন পড়াশুনা।আউসগ্রাম অঞ্চলের সর গ্রামে পণ্ডিত গোকুলানন্দ মহাশয়ের টোলে সংস্কৃত সাহিত্য পড়ার জন্য ভর্তি হলেন।এদিকে পিতার মৃত্যুর বর্ষ পূর্তির সময় এসে গেছে।রুপমঞ্জরী পিতার পরলৌলিক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে গেলেন গয়ায়।ক্রিয়া সম্পন্ন করে পৌছালেন কাশীতে।এখানে শাস্ত্র ব্যাখ্যার গভীর তত্ব অধ্যায়নের জন্য ভর্তি হলেন  টোলে।রুপমঞ্জরীর কঠিন সাধনা আর নিরলস পরিশ্রম  আর শাস্ত্র ব্যাখ্যার নতুন তত্ব উদ্ভাবন ক্ষমতা দেখে কাশীর টোল-চতুষ্পাঠীর বিদ্বান পণ্ডিত সমাজ তাঁকে 'তর্কালঙ্কার' উপাধি প্রদান করলেন।
         কাশীর পাঠ সমাপ্ত করে রুপমঞ্জরী আবার ফিরে এলেন জন্মস্থান কোটা গ্রামে, এবং একটি টোল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অধ্যাপনা করতে থাকেন।নানা রাজ্য থেকে আগত ছাত্রেরা রুপমঞ্জরীর টোলে চড়কসংহিতা,ব্যাকরণ,ন্যায়শাস্ত্র,জ্যোতিষ বিদ্যা,কবিরাজি চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যায়ন করতো।প্রায় শত আয়ু অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারিণী এই মহিলার স্বগ্রামে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু ঘটে।বলতে পারি আজীবন কৌমার্য ব্রতচারিণী, জ্ঞানতপস্বিণী রুপমঞ্জরী সর্ব প্রথমা আধুনিকা বজ্ঞ রমনী,যিনি পুরুষের বেশ ধারণ করে মাথায় শিখা রেখে সেই সতীদাহর যুগে বেশে,কর্মে ও যোগ্যতায় নিজেকে এক সম্মানীয়ায় পরিণিতা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
-----------------------------------------------------




No comments:

Post a Comment