খাজা আনোয়ার বেড়ের অস্তিত্ব আজ বিপ্নন
বর্ধমান শহরে মুসলিম ঐতিহাসিক ঐতিহ্যময় স্থান গুলির মধ্যে খাজা আনোয়ার বেড় সমাধি সৌধ ক্ষেত্রটি অন্যতম। একদিন বিশেষ এক কাজে বিবেকানন্দ কলেজ মোড়ে গিয়ে হাতে সময় আছে দেখে কৌতুহলী হয়ে চলে গেলাম খাজা আনোয়ার বেড়ের সমাধী দর্শনে।বইয়ে তো অনেক পড়েছি,একবার নিজের চোখেই দেখে আসি।কিন্তু একি দেখলাম! টোটো চালক দশ টাকা নিয়ে কলেজ মোড় থেকে দেড় কিলোলিটারের মতো পথ পেড়িয়ে যেখানে নামালেন এটাই সেই বর্ধমানের বিখ্যাত খাজা আনোয়ার বেড়?কিন্তু প্রবেশ মুখে একি ব্যানার ঝুলছে!' ব্যক্তিগত সম্পত্তি ', ' ছবি তোলা নিষেধ ',ব্যক্তি গত সম্পত্তি যখন তখন প্রবেশ করতেও ভয় হলো।তবে বাইরে থেকেই প্রথমে দুচোখ ভরে দেখে নিলাম বিশাল প্রবেশ পথে সদর দরজা,আর তার সোজা দূরে খাজা আনোয়ারের সমাধী মাজারের অপরুপ স্থাপাত্য সৌন্দর্য। প্রবেশ মুখে সদর দরজার ডান পাশে দেখলাম ছোট ছোট কুটরী গুলিতে কিছু পরিবার বাস করছে,ওঁদের একজন কে জিজ্ঞেস করলাম ' এখানে প্রবেশ করতে হলে কোথায় অনুমতি নিতে হবে?'তিনি আমাকে অপেক্ষায় রেখে একজনকে ডেকে আনলেন,আমারি বয়সের কাছাকাছি এক যুবক,আমি অনুরোধ জানালে তিনি প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন,কিন্তু সাবধান করে দিয়ে জালালেন, ' ছবি তুলে পেপারে দিলে কেস খেয়ে যাবেন কিন্তু ',আমি অভয় দিয়ে বললাম," না,না,তা হবে না।"
ওহ!হৃদয় যেন জুড়িয়ে গেল,কি অপরুপ বিন্যাস,কি আপরুপ তার সৌন্দর্য। মকরেবায় আছে তিন গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,মাঝে বাঁধানো পুষ্করিণী, তার মাঝে হাওয়া মহল।মোগল বংশের আজিম- উস - শানের পুত্র সম্রাট ফারুক শিয়র তখনকার দিনে দুই লক্ষ্য মুদ্রা ব্যয়ে শহীদ খাজা আনোয়ার ও তাঁর চারজন অনুচরের সমাধি ক্ষেত্র,নবাববাড়িটি নির্মান করে দয়েছিলেন।
১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি মহারাজ কৃষ্ণরাম রায়ের সময় বর্ধমান চাকলার বেশ কিছু অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা দেখা যায়,যেমন চেতুয়া ও বরদার জমিদার শোভা সিংহ,বিষ্ণুপুরের রাজা গোপাল সিংহ,চন্দ্রকোনার তালুকদার রঘুনাথ সিংহ,উড়িষ্যার পাঠান রহিম খাঁ রা একত্রে বর্ধমানের মহারাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন।১৬৯৬ তে চন্দ্রোকোণার যুদ্ধে কৃষ্ণরাম রায়ের মৃত্যু হলে শোভা সিংহের নেতৃত্বে বিদ্রোহী দল হুগলী,মেদিনীপুরের বিভিন্ন স্থানে লুণ্ঠন চালিয়ে বর্ধমানে রাজ মহলে হামলা চালায়।কোষাগার লুঠ করে কৃষ্ণরাম রায়ের পরিবাররে পঁচিশ জনকে হত্যা করা হয়।মদ্যপান করে মাতাল হয়ে শোভা সিংহ কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতীর কক্ষে প্রবেশ করে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে সত্যবীর চুলের খোপায় লুকিয়ে রাখা ছোট্ট ছুরির আঘাতে পাপী শোভা সিংহের মৃত্যু হয়।এর পর বিদ্রোহী দলের নেতৃত্বের লাগাম চলেযায় রহিম খাঁ র হাতে।রহিম খাঁ র অত্যাচার অবচারের সংবাদে দিল্লোর সম্রাট ঔরজ্ঞজেব বিচলিত হয়ে পড়েন,বাহাদুর শাহ্র পুত্র আজিম-উস-সান কে সুবেদার নিয়োগ করা হয় রহিম খাঁ কে দমন করার জন্য,সজ্ঞে দেওয়া হলো সম্রাটের অনুগত দুই বিশ্বস্ত সেনা খাজা সৈয়দ আনোয়ার ও খাজা আবুল কাসেম কে।
বর্ধমান শহরের দক্ষিণ দিকে দামোদর নদের নিকট ' মূলকাঠি ' নামের স্থানে দু পক্ষের যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধের মাঝে আজম-উস-শান দূত মারফত রহিম খাঁ র কাছে অনুরোধ পাঠালেন যে,যদি রহিম খাঁ নিঃশর্ত আত্ম সমর্পন করেন তাহলে তার পূর্বের সব অপরাধ মার্জনা করে উচ্চ রাজ পদে নিয়োগ করা হবে।চতুর রহিম খাঁ এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে আজিম-উস-সান কে দূতের মাধ্যমে আবেদন জানালেন,যদি তিনি খাজা আনোয়ারকে পাঠিয়ে এই চুক্তি সম্পাদন করেন তাহলে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করবেন।সহজ বিশ্বাসে মাত্র কয়েক জন সৈন্য নিয়ে আজিম-উস-শানের নির্দেশে খাজা আনোয়ার ও খাজা আবুল কাশেম রহিম খাঁ র শিবিরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন কেমন যেন অস্বাভাবিক পরিবেশ।শিবিরে প্রবেশ না করে তিনারা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন,কিন্তু বিশ্বাস ঘাতক রহিম খাঁ র সৈন্যদের হঠাৎ আক্রমনে অসম যুদ্ধে খাজা আনোয়ার ও খাজা আবুল কাসেম বীরত্বের সজ্ঞে মৃত্যুবরণ করেন(১৬৯৮)
এই দুঃখজনক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আজম_উস-শানের পুত্র ফারুক শিয়র খাজা আনোয়ার ও চার জন শহীদের কবর মাজার সৌধ নির্মান করে দেন।শুধু তা নয় তা রক্ষ্ণাবেক্ষনের জন্য বাদশাহী ফর্মানের মাধ্যমে (১৭১২)খাজা আনোয়ার এবং খাজা আবুল কাশেমের বংশধর গণকে কিছি গ্রাম প্রদান করা হয়েছেছিল।পরে বর্ধমানে বর্গী আক্রমনের সময় এই ফর্মানটি হাড়িয়ে গেলে খাজা আনোয়ার ও খাজা আবুল কাশেমের বংশধরদের আবেদনের ভিত্তিতে ১৭৬৭খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলম আরেকটি ফর্মান প্রদান করেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন এক ঐতিহাসিক স্থাপত্য স্থান টি রক্ষাণাবেক্ষনের অভাবে সসম্পূর্ণ ধ্বংস হতে বসেছে।পলেস্তারা খসে পড়েছে।সর্বত্র নোংড়া আবর্জনা ও আগাছায় ভর্তি।ভগ্নপ্রায় কুঠিরি গুলিতে বাস করছে কিছু পরিবার।পুষ্করিণীটি জলশূণ্য।ব্যক্তি সম্পত্তি হয়ে এখন বাংলা তথা বর্ধমানের গর্ব খাজা আনোয়ার বেড়ের ইতিসের অস্তিত্ব নির্ভর করে আছে এক অজানা ভবিষ্যতের উপর।
মোঃ8617386904
No comments:
Post a Comment