স্বাধীন্তা সংগ্রামী যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও চান্না আশ্রম।
ফিরোজ আলী কাঞ্চন
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম দিকে দলে প্রাধান্য ছিল মডারেট বা নরমপন্থীদের,এঁরা ব্রিটিশ সরকারে সজ্ঞে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরাধীন দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষা পুরন করতে চেয়েছিলেন,কিন্তু কার্জনের বজ্ঞভজ্ঞ বিরোধী আন্দোলনের সময় নরম পন্থীদের সজ্ঞে চরম পন্থীদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুটি ধারারই ব্যপক প্রভাব বাংলার অনান্য স্থানের সজ্ঞে সজ্ঞে বর্ধমান জেলাতেও পড়েছিল,অনেক তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ স্বাধীনের মহান ব্রতে।
বর্ধমান জেলাতে চরমপন্থী আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়।১৮৭৭খিষ্টাব্দে ১৯নভেম্বর উনিশ শতকের বৈপ্লবীক সংগ্রামের অগ্নিময় প্রতিমূর্তি এই যতীন্দ্রনাথবন্দোপাধ্যায়ের জন্ম গলসীর চান্না গ্রামে।এই চান্না গ্রামে আবার বাংলা শাক্তপদাবলীর বিখ্যাত পদকর্তা সাধক কবি কমলাকান্তের গ্রাম,যদিও কবির জন্ম অম্বিকা কালনায়,কিন্তু অকালে পিতৃবিয়োগের জন্য তিনি মায়ের সজ্ঞে চলে আসেন চান্নায় ;এখানের বিশালাক্ষী মন্দিরে পঞ্চমুন্ডি আসনে সাধক কবি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
সে যাই হোক,যতীন্দ্রনাথ ছিলেন বলিষ্ঠ সুস্বাস্থের অধীকারী,গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পাঠ সমাপ্ত করে তিনি বর্ধমানের রাজ কলেজে ভত্তি হলেন।চাত্রাবস্থাথেকেই যতীন্দ্রনাথের মনে স্বদেশ প্রেম আর জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটতে থাকে।তিনি স্থর করেন সামরিক বিভাগে যোগদিয়ে যুদ্ধের রণকৌশল আয়ত্ব করে তা দেশহিত ব্রতে প্র য়োগ করা।কিন্তু পিতা কালিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ইচ্ছে পুত্র কোন সরকারী উচ্চপদে চাকরী করুক।যতীন্দ্রনাথ রাজকলেজ থেকে এফ. এ. উত্তীর্ণ হয়ে বরোদায় নিজের নাম গোপন রেখে ছদ্মনামে অশ্বারোহী বিভাগে কাজে যোগদেন ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে।
বররোদার রাজ কলেজের অধ্যক্ষ্য তখন শ্রী অরবিন্দ ঘোষ।সেখানে দুজনের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে।যতীন্দ্রনাথ অরবিন্দ ঘোষের কাছে বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষিত হন।তরুন যুবক যতীন্দ্রনাথ অরবিন্দর কাছে অনুরোধ জানান দেশের কাজে নিজেকে নিবেদিত করার সুযোগ করে দেবার জন্য।অরবিন্দ তাঁর সসহোদর বারীন্দ্র কুমার ঘোষের সজ্ঞে যতীন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে
কলকাতায় পাঠান বভিন্ন গুপ্ত সমিতি ও বপ্লবী দলগুলির সজ্ঞে গোপনে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য।
অরবিন্দ ঘোষের নির্দেশে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে যতীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরেএসে চার নম্বর শ্যামাপুকুর লেনে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষনের বাড়িতে অবস্থান করে অনুশীলন সমিতির সজ্ঞে নিজেদেরকে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্তকরে দেন।বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে সজ্ঞেনিয়ে কানাইলাল দত্ত,সত্যেন বসু,উল্লাসকর দত্তদের সাহায্যে মানিকতলার মুরারিপুকুর লেনে এক বোমাতৈরীর কারখানা গড়ে তুলেন,এই কারখানাকেই কেন্দ্রকরেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিখ্যাত মানিকতলা বোমামামলার কাহিনী।
বজ্ঞভজ্ঞ আন্দোলনের পথনির্দেশিকা প্রদানের জন্য যতীন্দ্রনাথ ও বারীন্দ্রকুমার কল কাতায় আসার জন্য অরবিন্দ ঘোষকে আহ্বান জানান।অরবিন্দ বরোদার কলেজের সাড়ে সাতশত টাকার বেতনের চাকরী ছেড়েদিয়ে কলকাতায় এসে মাত্র পঁচাত্তর টাকার বেতনে জাতীয় কলেজে যোগদেন।যতীন্দ্রনাথ তাঁর তৈরীকরে দেওয়া বাংলা মায়ের একদল দামাল ছেলেকে অরবিন্দের দায়ীত্বে অর্পণ করে গুরু অরবিন্দের মন্ত্র শিষ্য হয়ে বৈপ্লবিক মতাদর্শকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
এই সময়ে পাঞ্জাবে করবৃদ্ধি ও চন্দ্রভাগা খালের জল কর আইনকে কেন্দ্রকরে বিপ্লববাদী শক্তি বৃদ্ধি পেতেথাকে।যতীন্দ্রনাথ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাবে পৌঁছে সেখানের বিখ্যাত বাবা গুরুদিৎ সিং সাহেবের সজ্ঞে সাক্ষাৎ করে বিপ্লবী দের একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত করেন,যে শাখার অন্যতম সদস্য ছিলেন ভগৎ সিংয়ের পিতা কিশন শিং;এক কথায় যতীন্দ্রনাথ পাঞ্জাবে যেন ' গদর পার্টি 'র বীজ রোপন করে দিয়ে আস লেন।
এতো কিছুর মধ্যেও যতীন্দ্রনাথের মনের গোপন কুঠিরে মাঝে মধ্যে যেন উদয় হতো এক একেবারে বিপরীত এক জীবনাদর্শন,তিনি যেন এই তীব্র বৈপ্লবিক জীবনের বাইরে আধ্যাত্মিক ভাবনায় মাঝেমধ্যে গভীর ভাবনায় তলিয়ে যেতে লাগলেন।আলমোরাতে অবস্থান কালে আধ্যাত্মিক সাধক শ্রীমৎ সোহহং স্বামীর নৈকট্য যেন যতীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি বদলে দেয়, সন্যাস গ্রহন করে নামনেন স্বামী নীরালম্ব।
স্বগ্রাম চান্নায় ফিরে এসে স্বামী নীরাল ম্ব খড়ি নদীর তীরে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত করলেন একটি আশ্রম।কিন্তু এই আশ্রমটি ক্রমে হয়ে উঠল কলকাতা থেকে বহুদূরে ব্রিটিশ পুলিশের চোখ এড়িয়ে বিপ্লবীদের আত্মগোপন করে থাকার বাংলার এক শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থান।রাসবিহারী বসু,ভগৎ সিং য়ের পিতা কিশন সিং সহ অসংখ্য বিপ্লবীর পদ ধূলি ধন্য এই চান্নার স্বামীনীরালম্বের আশ্রম।
শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় ১৯২৭খ্রিষ্টাব্দে স্বামী নীরালম্বকে তাঁর অন্যতম শিষ্য শ্রী বিজয় বসন্ত বসাক বরাহ নগরে নিজের উদ্যান বাটিতে চিকিৎসার জন্য নিয়েযান,এই সময় ভগৎ সিং ক লকাতায় ছিলেন,তিনি এসে স্বামী নীরালম্বের আর্শিবাদ গ্রহন করেন।অবশেষে ১৯৩০খ্রিষ্টাব্দে অগ্নিযুগের ব্রম্ভা নামে বাংলার চরমপন্থী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে সম্মানীয় স্বামী নীরালম্ব শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
এ হেন ঐতিহ্যময় চান্না গ্রামের স্বামী নীরালম্বের আশ্রম আজ প্রচারের অন্তরালে।নেই কোন নজরদারি বা রক্ষনাবেক্ষনের ব্যবস্থা।এক বৃদ্ধ সন্যাসী দেখাশুনা করতেন তিনিও গত হ য়েছেন।এ প্রতিবেদককে তিনি প্রায়ই আক্ষেপ ক রে বলতেন,এই আশ্রমটিকে আর হয়তো রক্ষা ক রা যাবে না,আমি মারা গেলে কে আর দেখবে।" আশ্রম সংলগ্ন আদিবাসী পাড়ার বাসীন্দারাই এখন মূলত তাদের ক্ষুদ্র সাধ্যমতো আগলে রেখেছে এই দেশপ্রেমের ঐতিহ্যময় স্থানটিকে।মাঝে মধ্যে বাৎসরিক অনুষ্ঠান কিছু উৎসাহী ব্যক্তি দ্বারা আয়োজিত হলেও সরকারী ভাবে এ আশ্রমটি অধিগ্রহন না করলে অচিরেই হয়তো হারিয়ে যাবে।
8617386904
No comments:
Post a Comment