বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত
ফিরোজ আলী কাঞ্চন
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম দিকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য ছিল মডারেট বা নরমপন্থীদের,এঁরা ব্রিটিশ সরকারে সজ্ঞে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরাধীন দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষা পুরন করতে চেয়েছিলেন,কিন্তু কার্জনের বজ্ঞভজ্ঞ বিরোধী আন্দোলনের সময় নরম পন্থীদের সজ্ঞে চরম পন্থীদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে।ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুটি ধারারই ব্যপক প্রভাব বাংলার অনান্য স্থানের সজ্ঞে সজ্ঞে বর্ধমান জেলাতেও পড়েছিল,অনেক তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ স্বাধীনের মহান ব্রতে,তেমনি একজন মহান বিপ্লবী, শহীদ ভগৎ সিং এর সহযোদ্ধা,বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী বটুকেশ্বর দত্ত।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলার খণ্ডোঘোষের নিকট ওঁয়াড়ি গ্রামে বটুকেশ্বর দত্তের জন্ম।মাতা কমলা কামিনী দত্ত,পিতা গোষ্ঠবিহারী দত্তকে রেলওয়েতে চাকুরীসূত্রে সপরিবারে থাকতে হয়েছিল উত্তর প্রদেশের কানপুরে,১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কানপুর মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হন,আর এই সময় পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার ও শোষণ তাঁর চেতকে গভীর ভাবে উদ্বেলিত করে।বটুকেশ্বর দত্ত সহ যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,শচীন্দ্রনাথ সান্যাল,রামপ্রসাদ বিলমিস প্রমুখ বিপ্লবীদের মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হল ' হিন্দুস্থান রিপাবলিকান পার্টি '।
পিতা-মাতা পুত্রের এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা মেনে নিতে পারলেন না,বটুকেশ্বর দত্তকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায় ট্রেলারিং শিখার জন্য(১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ)।কিন্তু এখানেও এই বিপ্লবী মানসিকতার কোন পরিবর্তন ঘটলো না,সংস্পর্শে আসেন কমিউনিষ্ট আন্দোলনের উল্লেখ যোগ্য ব্যক্তিত্ব মুজাফফর আহমদের,এবং তিনি যোগদান করের ভগৎ সিং,সুখদেব,ভগবতীচরণ ভোরা প্রমুখ বিপ্লবীদের ' নওজওয়ান ভারত সভা ' তে।সংগঠনের পক্ষথেকে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তর উপর দায়ীত্ব অর্পণ করা হলো লাহোরের অত্যাচারী ও ইংরেজ অফিসার স্যাণ্ডারসনকে হত্যা করার,এই কুখ্যাত অ্যাসিস্টাণ্ট সুপারিণ্টেণ্ড সাণ্ডারসনের নেতৃত্বেই দমন পীড়ন করে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ শে অক্টোবর লাহোরে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনে পুলিশি লাঠিচার্জে শ্রদ্ধেয় জননেতা লালা লাজপৎ রায়ের মৃত্যু হয়েছিল,তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠেছিল দেশপ্রেমী বিপ্লবীদের মনে,যে করেই হোক উপযুক্ত মোক্ষম একটা জবাব যেন দিতেই হবে।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর,লাহোরের কালেক্টর সাহেবের বাগান বাড়িতে প্রকাশ্য দিবালোকে বটুকেশ্বর দত্ত ও ভগৎ সিং বোমার বিষ্ফরণে ও গুলির গর্জনে ক্ষতবিক্ষিত করে দিল অত্যাচারী সাণ্ডারসনের দেহ, পুলিশের চোখ এড়িয়ে নিমিষে উধাও হয়ে দুজনে গিয়ে আত্মগোপন করলেন পাঞ্জাবের খাটকার নামক গ্রামে।কিন্তু এ স্থান নিরাপদ নয়,এদিকে সাণ্ডারসন হত্যা বিট্রিশ পুলিশের কাছে চরম আঘাত হানলো,লাহোর ষড় যন্ত্র মামলা দায়ের করে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে তন্ন তন্ন করে খোঁজ চালাতে লাগলো বিভিন্ন বিপ্লবীদের গোপন ডেড়াগুলিতে।বটুকেশ্বর দত্তর কানপুরেও পুলিশের গোয়েন্দা নজর রাখছে,পাঞ্জাব,রাজপুতানা,উত্তর প্রদেশের নানা জায়গায় আত্মগোপন করে থেকে দুজনে চলে এলেন বটুকেশ্বর দত্তর দেশের বাড়ি জন্মস্থান ওঁয়াড়িতে,বাংলার দক্ষিণ দামোদরের কোল ঘেষে নির্জন এই গ্রাম যেন সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী,পরাধীন ভারতের সবচেয়ে দীপ্ত দেশপ্রেমিক বিপ্লবী ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তর নিরাপদ আশ্রয়স্থল।এ প্রসজ্ঞে বলতে হয় কেন জানিনা আমাদের বর্ধমান জেলার অতীত অনেক কালথেকেই সারা দেশের রাজনৈতিক পটভূমিকার পরিবর্তনকারীদের বারবার আত্মগোপন করে থাকার আশ্রয় স্থান। মুঘল যুগে ফারুক শিয়র, শেরশাহ সহ অনেক ভারতের প্রধান চরিত্ররা এখানে গোপনে কাটিয়ে গিয়েছিলেন,তেমনি আবার চান্নাগ্রামে অগ্নিযুগের ব্রম্ভা স্বামী নীরালম্বের বা যতীন্দ্রনাথের আশ্রমে ব্রিটিশ পুলিশের চোখ এড়িয়ে গোপনে থেকেছিলেন রাসবিহারী বসু সহ অনেক বিপ্লবী। শোনাযায় জরুরী অবস্থার দিনগুলিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে নিরাপত্তার জন্য গোপনে রাখা হয়েছিল পানাগড়ে মেলেটারি ক্যাম্পে।মুঘল যুগে জেলাকে 'শরিফাবাদ ' বলা হতো,অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বাসস্থান,মহাবীর বর্ধমানের পদধূলি ধন্য এ জেলার এ গৌরব অখণ্ড বাংলা তথা সারা দেশের মধ্যে একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট বলা যেতে পারে।
কিন্তু স্বগ্রাম ওঁয়াড়িতে বটুকেশ্বর দত্তর করগেটের চাউনি দেওয়া মাটির দেওয়ালের পৈত্রিক বাড়িটিও যেন নিরাপদ মনে হলো না,সংবাদ এলো পুলিশ তল্লাসিতে আসছে,বটুকেশ্বর বাড়ির পিছনেই প্রতিবেশী নগেন্দ্রনাথ ঘোষ ও খগেন্দ্রনাথ ঘোষেদের পাতালঘরে নিরাপদে আশ্রয় নিলেন দুই বিপ্লবী। পুলিশ এসেও কোন সন্ধান পেলো না,এ দিকে এই পাতালঘরের গভীর অন্ধকারে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনার ছক সাজিয়ে নিলেন।তিন দিন তিন রাত্রি পাতালঘরে কাটিয়ে পুলিশের ফিরে যাওয়ার পর ভগৎ সিং ও বটুকেস্বর দত্ত ছদ্মবেশে ওঁয়াড়ি গ্রাম ত্যাগ করলেন।
১৯২৯ সালের ৮ ই এপ্রিল, পার্লামেন্টে ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করে জন নিরাপত্তা বিল ও শিল্প সংক্রান্ত ট্রেডার্স ডিসপিউট বিল দুটি অনুমোদন করেনিতে চায়।এমন সময় দর্শক গ্যালারি থেকে নিক্ষিপ্ত হলো বোমা,ভয়ংকর বিষ্ফরণে কেঁপে উঠল চারিদিক, আইন সভার কক্ষ ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল,আর ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তর কন্ঠে ধ্বনিত হল ভারতের রাজনীতির সেই দীপ্ত।স্লোগান, " ইনকিলাব -জিন্দাবাদ ",সেই সঙ্গে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন বিল্পবীদের ইস্তেহার।বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করলেন ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর।শুরু হলো বিচারের নামে প্রহসন।বিপ্লবীদের পক্ষে আইনজিবী নিযুক্ত হলেন আসফ আলী সাহেব।দায়রা বিচারক মিস্টার হিলটনের বেঞ্চে যুক্তিপূর্ণ সওয়াল করে আসফ আলী খান জয়ী হলেন,কিন্তু কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিশেষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিস্টার হিলটন বিনা বিচারে ভগৎ সিং,রাজগুরু ও শুকদেবের ফাঁসী এবং বটুকেশ্বর দত্তর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেন।
১৯৩০ থেকে পাঁচ বছর আন্দামানের সেলুলার জেলে ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে না পরে বটুকেশ্বর দত্ত অসুস্থ্য হয়ে পড়েন,পরের দু বছর আলমোড়া এবং দিল্লী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাটান,নজরবন্দী অবস্থায় পুলিশের চোখ এড়িয়ে বড়দাদা বীরেশ্বর দত্তর পাটনার বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতে লাগলেন।১৯৪১ খ্রিষ্টাবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বারোবছর পূর্ণ হলে তিনি নিস্কৃতি লাভ করেন।কিন্তু ১৯৪২ এর ভারতছাড়ো আমন্দোলনে আবার তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন,দায়ীত্ব নিলেন বিহারের।আবার তিনি বন্দী হলেন,এদিকে ভারতের রাজনীতিতে তাঁর বন্দীদশাবস্থায় ঘটে যেতে লাগলো বিশেষ বিশেষ পটপরিবর্তন,১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট স্বাধীন হলো দেশ,দুঃখের বিষয় তখনো তিনি জেলে, এই বন্দীবস্থাতেই ১৮ই নভেম্বর বড়ো দাদা বীরেশ্বর দত্তর উদ্যোগে বটুকেশ্বর দত্তের বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়,প্রথম প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বিশেষ অনুমতিতে পুলিশি ঘেরাটোপে বটুকেশ্বর দত্তর সেই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শহিদ ভগৎ সিংয়ের মাতা বিদ্যাবতী দেবী।১৯৪৮ সালে সাজার মেয়াদ শেষ হবার পর তিনি দেওঘরে মেজদাদা বিশ্বেশ্বর দত্তর কাছে স্ত্রী অঞ্জলি দাসকে নিয়ে আশ্রয় নেন,এখানে কিছুদিন কাটানোর পর পাটনায় স্থান্তরিত হন।১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিহারের বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।কিন্তু শরীর যেন আর টানতে পারলো না,১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ শে জুলাই দিল্লীর ইণ্ডিয়ান মেডিকেল ইন্সিটিটিউডে ভগৎ সিং জননী বিদ্যাবতী দেবীর কোলে মাথারেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগকরলেন।শেষ ইচ্ছা অনু্যায়ী বটুকেশ্বর দত্তর মরদেহ পাঞ্জাবের ফিরোজাবাদে শহীদ ভগৎ সিংয়ের সমাধীর পাশে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধীস্ত করাহয়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বর্ধমান জেলার ওয়াড়ি গ্রামের এই বীর সন্তানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থেকে যাবে চিরটা কাল
------------------------------
No comments:
Post a Comment