Monday, May 4, 2020

      যাত্রা পালাকার ও নির্দেশক শ্রী ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়
                        
                          



ঈশাননাগর ঠাকুরের ' অদ্বৈতপ্রকাশ ' গ্রন্থে পাওয়াযায়-' শ্রীনাট মন্দিরে দেখি চৈতন্যের লীলা/অশ্রুনীরে ভাসি দেবী হইলা উতলা'। গবেষকগণ একমত যে গীতগোবিন্দ,শ্রীকৃষ্ণলীলা ও মহাপ্রভুর ভাববিহ্বলিত লীলামাহাত্বের প্রকাশের মাধ্যদিয়েই যাত্রাপালার উদ্ভব। এ সূত্রধরেই ডঃ সুকুমার সেনের অভিমত,' যাত্রা শব্দের মূল অর্থ হইতেছে দেবতার উৎসব উপলক্ষে শোভাযাত্রা ও উৎসব।'আবার ডঃ অজিত ঘোষ মনেকরেন,' মঙ্গল গান,লোক সঙ্গিত,পালা গান ইত্যাদি নানা ধারা বিবর্তনের মধ্যদিয়া সম্ভবত যাত্রাগানে রুপান্তরিত হয়েছিল।'

   ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেগেছেন,যাত্রায় ' লোক শিক্ষ্যে' হয়।যাত্রাপালা এমন এক মাধ্যম যেখানে একসাথে কয়েক হাজার হাজার একেবারে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে বিনোদনের মাধ্যমে কোন বার্তা প্রেরণ করতে পারে, অন্য কোন বিনোদনের ধারায় সম্ভব নয়।বাংলার গ্রামে গ্রামে ধান কাটার পর গ্রাম্যকোন মেলা উপলক্ষ্যে কলকাতার পেশাদার যাত্রাপালার দলগুলির আগমন ও বড়ো মঞ্চে,চড়া আলোয়,চারিদিকে ত্রিপলে ঘেরায় হাজার হাজার দর্শক যেন দুচোখ ভরে একেবারে মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করতো শহুরে রক্তমাংশের চকচকে অভিনেতা-অভিনেত্রিদের কণ্ঠের আভিজাত্য স্বর ও অনবদ্য অভিনয়।মাটিতে বসে বাদাম খেতে খেতে এই কয়েক দশক আগের যাত্রাপালার স্বর্ণযুগের সেই দিনগুলি আজ যেন ইতিহাস।

   বাংলায় যাত্রাপার উদ্ভবের ইতিহাস বহু প্রাচীন।চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগে রামযাত্রা,সীতার বনবাস,শিবের গাজন প্রভৃতি কাহিনীর অভিনয়ের প্রথা প্রচলিত ছিল।শ্রী চৈতন্যের কৃষ্ণলীলার ভাববিহ্বলতার মাধ্যমে যাত্রাপালা লোকসমাজে ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভকরে।গবেষকদের তথ্যঅনুযায়ী 'রক্ষিনী হরণ ' নামে এক কৃষ্ণপালায় স্বয়ং চৈতন্যদেব অভিনয় করেছিলেন।অষ্টাদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত যাত্রাপালায় মূলত ছিল পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর,ঊনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকে দেশাত্মবোধক কাহিনী যাত্রাপালায় গুরুত্বপেতে থাকে।যাত্রাপালার ক্রমবিকাশের ধারায় ক্রমে প্রবেশ করে ঐতিহাসিক,সামাজিক,রাজনৈতিক কাহিনীর।

    দুঃখের বিষয় যে যাত্রাপালায় পেশাদার যাত্রাদলের মাধ্যমে একটা সময় বাঙালীর কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে অবস্থান করেছিল,বর্তমানে যাত্রাপালার সেই স্বর্ণযুগ আর নেই।এখন বিনোদনের নানান মাধ্যম,যাত্রাপালার প্রাণকেন্দ্র যে প্রান্তিক গ্রামগুলি,সেখানেও আজ আধুনিকতার ছোঁয়া।কলকাতায় যে কটি পেশাদার দল টিকে আছে সেগুলির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন,গ্রামাঞ্চলে এমেচার যাত্রাদল গুলি শুধু শখের বসে আর যাত্রাপাগল কিছু মানুষের যাত্রার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় নিজেদের 'জেদ' বজায় রেখে আজও গ্রাম্যঅনুষ্ঠান গুলিতে যাত্রাপালার আয়োজন করেথাকে,তবে পোশাকের খরচ,মহিলা অভিনেত্রীর অভাব বা নতুন প্রজন্মের উদাসীনতায় এই প্রচেষ্টা এখন খুবই বাধা বিপত্তির মধ্যেও নিজেদের ধরে রেখেছে।এমেচার যাত্রাপালার পোশাক,বাদ্যযন্ত্র বা মহিলা অভিনেত্রী যোগানদেয় যে সংস্থাগুলি সেগুলিও যেন ধুকছে।হয়তো এভাবে চলতে থাকলে আর কয়েক প্রজন্ম পর লোকনাট্যের এই ঐতিহ্যময় ধারাটি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

         বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার ধারাকে যিনি জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন এবং বাংলার সমস্ত সুধী যাত্রামোদী অভিনেতা,পরিচালক এবং দর্শকদের কাছে যিনি যাত্রাপালার ধারায় সরস্বতীর বরপুত্র,সেই অতি সুপরিচিত বিখ্যাত পালাকার শ্রী ভৈরব নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে নবেম্বর বর্ধমান জেলার মুলগ্রাম নামক গ্রামে।ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের যাত্রাজগতে প্রবেশ 'নাচমহল ' পালা রচনার মাধ্যমে,তারপর আর কলম থেমে থাকেনি,একের পর এক তিনি যাত্রামোদী বাংলার দর্শক ও অভিনেতা অভিনেত্রীদের  উপহার দিয়েগেছেন বিখ্যাত বিখ্যাত সব যাত্রাপালা।

               সামাজিক,ঐতিহাসিক,পৌরাণিক সব ধারার পালাতে ভৌরবগঙ্গোপাধ্যায়ের ছিল অবাধ বিচরণ।সামাজিক নাটক গুলিতে প্রতিফলিত হয়েছিল সমাজের দর্পণ,এই পর্যায়ের বিখ্যাত নাটক গুলি হলো -' দেবী-সুলতানা ', 'লক্ষ্মীর পদচিহ্ন ', ' এক পয়সার মা ',পাঁচ পয়সার পৃথিবী ',' কান্না ঘাম রক্ত ','ময়লা কাগজ ', 'মা-মাটি-মানুষ ', ' ঘুম নেই', ' ভগবান বাবু ',' পদধ্বনি ','রক্তে রোয়া ধান ','জানোয়ার ','পরশপাথর ' ইত্যাদি।ঐতিহাসিক যাত্রাপালাগুলিতে ইতিহাসের কাহিনীর সাথে কল্পনার মিশ্রনে জাতীয়তাবোধ,দেশপ্রেম,ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘটিয়েছেন।দ্বন্দ্বের টানাপোরেনে ঐতিহাসিক পালাগুলি হয়েউঠেছে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ।' বাঁদী লালবাঈ','বেগম আশমানতারা','দেবী মালিনী ','ফেরারী বান্দা' ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।পৌরাণিক যাত্রাপালার মধ্যে উল্লেখ্য-'শাপ মুক্তি','স্বর্গ হতে বিদায় '।তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'গণদেবতা ' উপন্যাসকে তিনি যাত্রাপালার রুপ দিয়েছিলেন এছাড়াও ' অচল পয়সা','ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ','বৌ হয়েছে রঙের বিবি','স্বর্গের পরে স্টেশন','পালকি ভাঙা বৌ','চিড়িতনের বিবি' প্রভৃতি যাত্রাপালার নামগুলি আজো গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষদের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে।
                আধুনিক যাত্রাপালার রুপকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৯৮খ্রিষ্টাব্দে২৮শে ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন।ভৌরব গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন,' পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা স্বর্ণালী যুগেরও অবসান ঘটলো।'সত্যিই তাই একাধারে পালাকার,নির্দেশক,গীতিকার, সুরাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের শূণ্যতা যেন আর পূরণ হবার নয়।বাংলার যাত্রামোদী সুধী সমাজের মনের মণিকোঠায় ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় অমর হয়ে থাকবেন চিরটাকাল।






       

ছবি
(ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি দুটি ইনার পুত্র দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত)
ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় এর মূল গ্রামে মূর্তি ও, মূলগ্রামে পালাকারের বসতভিটে

No comments:

Post a Comment