Friday, June 7, 2019

গলসীর বাঘারাজাদের ঢিপি
------ফিরোজ আলী কাঞ্চন

রাঢ়বাংলার মধ্যমণি বর্ধমান জেলার গলসী এক প্রাচীন জনপদ। এর আগে এ অঞ্চলের মাটির নীচে থেকে একাধিকবার পাওয়া গেছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন, যেমন, মল্লসারুল নামক গ্রামে পাওয়া গেছে বাংলার প্রাচীন তাম্রপট্ট লিপি "মল্লসারুল লিপি"। এবার থেকে সেই তালিকায় যুক্ত হতে পারে খানোগ্রামে বাঘারাজাদের ঢিবি থেকে প্রাপ্ত আজ থেকে প্রায় দুহাজার বছর পূর্বের বিভিন্ন পোড়ামাটির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
      গ্রামের যেটা বারোয়ারী খেলার মাঠ সেটা আসলে এক ঢিপি,স্থানীয়রা বলেন বাঘা রাজাদের ঢিপি। আমি ঐতিহাসিক নই, পেশায় শিক্ষক, নেশা আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকায়ত ঐতিহ্য সর্ম্পকে জানা । সেই আগ্রহ থেকেই একদিন পৌছালাম সেখানে,যা দেখলাম  বিস্ময় আর হতাশা যেন চেপে রাখতে পারলাম না। সর্বত্র যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য প্রাচীন পোড়া মাটির বিভিন্ন ভগ্ন পাত্রের অংশ। ছোট যে ঢিপি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে  গ্রামবাসীরা তার মাটি অবৈধ ভাবে কেটে নিয়ে ঢিপিটিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে,আর সেই সঙ্গে সেখান থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন গুলিকে পুরোপুরি ফেলে,ভেঙে, নষ্ট করে দিচ্ছে।আমার অনভিজ্ঞ দৃষ্টি সে সবের ঐতিহাসিক মূল্য নির্ণয় করতে অক্ষম। সময় নষ্ট না করে কুড়িয়ে নিতে থাকলাম খণ্ডবিখণ্ড  বিভিন্ন পোড়ামাটির কালো,লাল,ধূসর বর্ণের পাত্রের অংশ। জি সি পি দিয়ে  প্রায় সাত আট ফুট খাল কেটে মাটি তুলে গ্রামের রাস্তায় দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে যন্ত্রদানবের থাবার আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সে সব পাত্র গুলি।একটি পোড়ামাটির থাম বা পিলারও দেখতে পেলাম।আমার সংগ্রহ করা দেখে উপস্থিত বাসিন্দারা হাসাহাসি করতে লাগলেন," কি সব খোলামকুচি কুড়াচ্ছেন !" কয়েকটা প্রাণীর হাড়ও পেলাম।
          সংগৃহীত  নিদর্শন গুলির ছবি দেখে বিভিন্ন  প্রত্নতাত্বিক গবেষকগণ এগুলির সময় কাল তাম্রশ্মীয় যুগের, খ্রীষ্টপূর্বাব্দের বলে অনুমান করেছেন। চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং তাঁর গ্রন্থে গলসীকে বলেছেন উতু প্রদেশ। জগৎ রায় মুগল সম্রাট আলমগীরের কাছ থেকে যে ৪৯টি মৌজার জমিদারিত্ব পেয়েছিলেন, সেগুলির মধ্যে ' বাঘাপরগনা ' বলে এ অঞ্চলের উল্লেখ ছিল। বহু পূর্বে থেকেই গলসী অঞ্চলে ছিল বাঘারাজাদের রাজত্ব। তাদের রাজবাড়ি ছিল এই খানো গ্রামে। পার্শবর্তী বড়মুড়িয়ে  ও ছোটমুড়িয়ে গ্রামদুটির নাম হয়েছে এই খানোরাজবাড়িকে কেন্দ্রকরেই। বাঘারাজাদের রাজবাড়ি যাবার যেটা প্রধান মোড়, সেখানে গড়ে ওঠা গ্রাম হয়েছে 'বড়োমোড় 'বা বড়োমুড়িয়া,আর যেটা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সেটা হয়েছে ' ছোটমোড় ' বা ছোটমুড়িয়া।
      মধ্যযুগে এই বাঘারাজাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।  এর বেশী কিছু তথ্য অমিল।এই ঢিপিতে কোন রাজার প্রাসাদ ছিল?,কত সাল?সে সব আজ আমাদের উদাসীনতায় অজানা। যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুও গ্রামবাসীর অসচেতনতায় ধ্বংস হতে বসেছে।
      জানি ইতিহাসের অমূল্য এই সম্পদগুলি এ ভাবে ব্যক্তিগত ভাবে সংগ্রহ করার অধিকার আমার হয়তো নেই,কিন্তু একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গ্রামবাসীদের অবহেলা ও সরকারের উদাসীনতায় এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছি।আমি সুযোগ পেলে অবশ্যই এগুলি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে চাই। সেই সঙ্গে আবেদন করি যে, অবিলম্বে এখানে গলসি ব্লক আধিকারিকের উদ্যোগে অবৈধ মাটিকাটা বন্ধ করা হোক। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালযের ইতিহাস বিভাগ বা রাজ্যপুরাতাত্বিক কর্তৃপক্ষের কর্তা ব্যক্তিগণ পরিদর্শনে এসে এ স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে নিশ্চিত করুন।
       সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালীর ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করে ছিলেন। সে আক্ষেপ আজও আমাদের রয়ে গেলো। বাঘারাজার ঢিপি আজও তাই হতাশার গভীর অন্ধকারে চাপা। হয়তো এখানে পরশ পাথর নেই,হয়তো বা আছে। তার চেয়েও বড়ো কথা বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসের পরিপূর্ণতা এগুলির সঠিক তথ্য অনুসন্ধান ছাড়া অসম্ভব।

কিভাবে যাবেন : নবাবহাট থেকে গলসীগামী লোকাল বাসে চেপে খানো গ্রাম স্টপেজে নামতে হবে।ট্রেনে আসানসোল লোকালে খানাজংশনে নেমে টোটোয় চেপে কুল গড়িয়ে বাজার হয়ে খানো গ্রামে যাওয়া যায়, বা ঈশান চণ্ডী হল্ট ষ্টেশনে নেমেও যাওয়া যায়।








প্রাপ্ত নিদর্শনএর কিছু ছবি,আনন্দ বাজার,কলম ও উর্দু পেপারে প্রকাশিত সংবাদ।লেখাটি এই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত।ঢিবির নিদর্শন এর সন্ধান সাল ২০১৮  ।লেখা ও ছবি অন্য কোথাও প্রকাশ নিষিদ্ধ।তথ্য অবশ্যই নিতে পারেন, কপি করবেন না,লিংক সেয়ার করতে পারেন।  

No comments:

Post a Comment