Sunday, November 10, 2019



' বর্ধমান হচ্ছে কলকাতার মা '

           ফিরোজ আলি কাঞ্চন

শিরোনামের এই দাবি বিশিষ্ট  ভাষাচার্য ও বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃসুকুমার সেনের। কলকাতা নগর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় জেলা বর্ধমানের এক ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে,সে ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক যেন অনেকটা অভিভাবকের মতো।আর দেশ বা মাতৃভূমি আমাদের কাছে  মাতৃজ্ঞাণে পূজিত, তাই তিনি 'মা',এখানে অভিভাবিকা যেন।
          ব্রিটিস ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রশাসক জব চার্নক বাংলার নবাবের কাছথেকে১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে সুটানুটি অঞ্চলে কুটি স্থাপনের অনুমতি লাভ করেন।অবশ্য সুটানুটি,গোবিন্দপুর ও কলকাতা গ্রাম গুলির সত্বাধিকারী তখন ছিল সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের।কিন্তু ক্রমে ১৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে জব চার্নকের জামাতা চার্লস আয়ার মাত্র ১৩০০ টাকার মূল্যে সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর নিকট হতে গ্রাম তিনটির সত্ত্বাধিকারী ক্রয় করে নেন, এই সূত্র হিসেবে আমরা জেনে এসেছি জব চার্নক কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস এই ধারনা থেকে বেড়িয়ে এসেছে,কেননা একটা শহর বা নগর কোন ব্যক্তির একক উদ্যোগে কখনো গড়ে উঠতে পারে না।তাছাড়া আবুল ফজলের ' আইন-ই-আকবরি '(১৫৯০)গ্রন্থ সহ একাধিক গ্রন্থে  ' কলিকাতা ' নামটি পাওয়া যায়।এ প্রসজ্ঞে যেটা আরো গুরুত্ববহ, কলকাতা  হাইকোর্ট ২০০৩ সালে এক জনস্বার্থ মামলার রায়ের উল্লেখে জানিয়েছে কলকাতার প্রতিষ্ঠা কোন এক নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়।
           প্রকৃতপক্ষে কলকাতার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইতিহাসের এক ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়ায়,আর এই প্রক্রিয়ায় অভিবাবকত্বের ভূমিকায় ছিল জেলা বর্ধমান,আর সেই মর্যাদায় গৌরবান্বিত বোধকরে  ডঃ সেন বর্ধমান জেলাকে ' কলকাতার মা ' বলে অভিহিত করেছেন,আর এই উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের আরো অন্য এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
        বর্ধমানের মহারাজা তখন কৃষ্ণরাম রায়(১৬৭৫-১৬৯৬)।এই সময় বর্ধমান চাকলার বেশ কিছু অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে,যেমন -চেতুয়া ও বরদার জমিদার শোভাসিংহ,চন্দ্রকোনার তালুকদার রঘুনাথ সিংহ,উড়িষ্যার পাঠান রহিম খাঁন প্রমুখ গণ, এঁরা সকলে একত্রিত হয়ে বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম রায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রকোনার যুদ্ধে মহারাজা কৃষ্ণরাম রায়ের মৃত্যু হলে শোভা শিংহের নেতৃত্বে বিদ্রোহী দল মেদিনীপুর ও হুগলীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যা ও লুঠতরাজ চালিয়ে প্রবেশ করে বর্ধমান রাজমহলের অন্তঃপুরে,এই ঘটনা ছিল বর্ধমান রাজপরিবারের ইতিহাসে এক চরম অভিশাপ স্বরুপ।বিদ্রোহী দল রাজকোষাগার লুণ্ঠন করে,শুধু তাই নয় রাজ পরিবারের পঁচিশ জন সদস্য কে নির্বিচারব হত্যাকরে,সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হল মদ্যপ শোভাসিংহ মাতাল হয়ে কৃষ্ণরাম রায়ের কণ্যা রাজকুমারী সত্যবতীর কক্ষে প্রবেশ করে সত্যবতীকে সম্ভোগ করতে উদ্যত হয়,কিন্তু রাজকুমারী কেশপাশে লুকিয়ে রাখা তীক্ষ্ণধার ছুরি দিয়ে  লম্পট চরিত্রহীন শোভাসিংহের উদর বিদীর্ণ করে দেয়।
        শোভাসিংহের মৃত্যুর পর বিদ্রোহী দলের নেতৃত্বের লাগাম চলেযায় উড়িষ্যার বিদ্রোহী পাঠান রহিম খাঁর হাতে।সমগ্র বর্ধমান জেলাজুড়ে চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ ও লুঠতরাজ। এদিকে শরিফাবাদ বর্ধমানের এই চরম অরাজকতার সংবাদে বিচলিত হয়ে উঠেন দিল্লীর সম্রাট। ঔরঙ্গজেব স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে নিজের নাতি, অর্থাৎ বাহাদুর শাহর পুত্র আজিম-উস-সানকে সুবেদার নিয়োগ করে বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে বর্ধমানে প্রেরণ করেন।আজিম-উস-সানের সাথে পাঠানো হলো বিশ্বস্ত উজির খাজা সৈয়দ আনোয়ারকে।
         বর্ধমানের এই অরাজকতা সারা বাংলার ক্ষেত্রে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না,আর সে সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য অতি মাত্রায় সচেষ্ট হয়ে উঠে বণিকের ছদ্মবেশে আমাদের দেশে আগত বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিগুলি।এই প্রচেষ্টায় সহায়ক হয়ে উঠে কুচক্রী ও দূরদৃষ্টিহীন আজিম-উস-সান, অবশ্য তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দিল্লীর সিংহাসনের দখল,এ জন্য যেন তেন প্রকারেণ অর্থ সংগ্রহে তিনি ছিলেন খুবই আগ্রহী। অর্থের বিনিময়ে তিনি ওলন্দাজদের চিনমুখায় ফোর্ট গুস্টাভাস এবং চন্দন নগরে ফরাসিদের ফোর্ট অর্লিন্স গড়ে তোলার অনুমতিও দিয়েছিলেন।অন্যদিকে পূর্ববর্তী বাংলার সুবেদার ইব্রাহিম খাঁর নিকট হতে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী দুর্গ নির্মানের যে অনুমিত পেয়েছিল,সে অনুমতির ভিত্তিতে সুটানুটি,গোবিন্দপুর ও ডিহি কলকাতা গ্রাম তিনটি পুরোপুরি ক্রয় করার পরিকল্পনা গ্রহন করে।আজিম-উস-সান বর্ধমানে অবস্থান করেছেন দেখে কোম্পানির পক্ষথেকে প্রতিনিধি দল আবেদনের আর্জি নিয়ে উপস্থিত হন বর্ধমানে,কোম্পানীর পক্ষেথেকে এই কার্য সমাধান করার বিশেষ দায়ীত্বে ছিলেন ওয়ালস।কিন্তু বিচক্ষণ ও দূরদর্শী  উজির খাজা আনোয়ার এ প্রস্তাব সঙ্গেসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন,তিনি আজিম-উস-সানকে পরিস্কার জানিয়ে দেন এ প্রস্তাব সম্পাদিত হলে ভবিষ্যৎ হবে ঘোর মারাত্মক,ফলে প্রস্তাব নাকচ হয়েগেল।
         কিন্তু দুঃখের বিষয় দামোদর নদের দক্ষিণে ' মূলকাঠি 'নামক স্থানে রহিম খাঁর বিশ্বাস ঘাতকতায় খাজা আনোয়ারের মৃত্যু ঘটে।সন্দেহ জাগে এ বিশ্বাসঘাতকতা আবার আজিম-উস-সানের ছিল না তো! তিনি হয়তো ভেবেছলেন দিল্লীর সম্রাটের অনুগত এই উজির তার স্বপ্নের বাস্তবয়ানের পথে বর্ধমানের সফরে বাধা হয়ে উঠেছে?যদিও বর্ধমানের ঐতিহাসিকগণ তেমন কোন ইঙ্গিত দেননি,তবে ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে প্রাবন্ধিকের প্রশ্ন অমূলক নয়।যুদ্ধের মাঝে আজিম-উস-সান দূত মারফত রহিম খাঁর কাছে অনুরোধ পাঠালেন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলে ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে।রহিম খাঁ স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন।আজিম-উস-সান মাত্র কয়েকজন সৈন্য দিয়ে খাজা আনোয়ারকে পাঠালেন চুক্তি সম্পাদনের কাজে!খাজা আনোয়ার রহিম খাঁর শিবিরে উপস্থিত হয়েই টের পেলেন কেমন যেন সন্দেহের পরিবেশ,তিনি শিবিরে প্রবেশ না করে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলেন,কিন্তু অতর্কিত আক্রমণে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তিনি শহীদ হন (১৬৯৮)।এই দুঃখ জনক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ফারুক শিয়র খাজা আনোয়ার ও চারজন শহীদের মাজার সৌধ ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় দুই লক্ষ্য মূদ্রা ব্যয়ে নির্মাণ করেন,বর্ধমান শহরের বেড় এলাকায় অবস্থিত এই স্মৃতি সৌধের মকরেবায় রয়েছে তিন গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,বাঁধানো পুষ্করিণীর মাঝে হাওয়া মহল।সেদিন খাজা আনোয়ারের মৃত্যু না হলে ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইতিহাস হয়তোবা অন্যভাবে রচিত হত।
     আজিম-উস-সান বর্ধমানে অবস্থানকালে সঙ্গে এনেছিলেন দুই পুত্র করিম উদ্দিন ও ফারুক শিয়কে।খাজা আনোয়ারের মৃত্যু যেন কোম্পানীকে স্বস্তি এনে দিল।ফারুক শিয়রকে প্রভাবিত করে আবার তারা ঝুলে থাকা প্রস্তাব পুর্নবিবেচনার জন্য আবেদন জানালো।আর এই আবেদন প্রস্তাবের জন্যই যেন আজিম-উস-সান অপেক্ষায় ছিলেন,ষোল হাজার টাকার বিনিময়ে সুটানুটি,গোবিন্দপুর ও ডিহি কলকাতা গ্রাম তিনটি তিনি ইংরেজ কোম্পানীকে বিক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করলেন ১৬৯৮ সালে নভেম্বর মাসে।চুক্তি পত্রে দেওয়া হয়েছিল কাজির মোহর,ছিল জমিদার গণের স্বাক্ষর, বার্ষিক খাজনা নির্ধারণ হয়েছিল ১১৯৪ টাকা ১৪আনা ৫পাই।
         কোম্পানীর সঙ্গে আজিম-উস-সানের এই চুক্তি সম্পাদনের সই সাবুদ ঠিক কোন স্থানে হয়েছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে,কলকাতার ঐতিহাহিক গণের এ ক্ষেত্রে বর্ধমান জেলাকে মর্যাদাদিতে যেন কৌলিণ্য ক্ষুণ্ণ  হয়! কিন্তু বর্ধমানের ভূমিপুত্র  ডঃসুকুমার সেন বা বর্ধমানের ইতিহাস রচয়িতা যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী,সাহিত্য বিনোদ নীরদবরণ সরকার প্রমুখগণ এ ক্ষেত্রে বর্ধমানের মাটিকেই চিহ্নিত করেছেন।আর এ দাবিই যুক্তিযুক্ত,কেননা আজিম-উস-সানের বর্ধমানে অবস্থান মাত্র কিছু দিনের জন্য অস্থায়ী ছিল না,তিনি বেশ কিছুটা সময় বর্ধমানে অতিবাহিত করেছিলেন,সজ্ঞে পুত্রদেরও এনেছিলেন।বর্ধমান শহর পায়রাখানা গলিতে অবস্থিত জুম্মা মসজিদটি তনি ১৬৯৯খ্রিষ্টাব্দে ইবাদতের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন,কাজেই এও স্বাভাবিক।তিনি শাসন কার্য বর্ধমান থেকেই পরিচালনা করতেন,এবং চুক্তি রাঢ় বাংলার মধ্যমণি বর্ধমানেই সম্পাদিত হয়েছিল,সেই আব্দারের দাবিতে সম্পর্কতো থাকবেই।
------------------
।প্রবন্ধটি গলসি বিবেকানন্দ  ক্লাবের সারদীয় পুজো পত্রিকায় ২০১৯ প্রকাশিত
            ফিরোজ আলি কাঞ্চন

গলসির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

915
        
     
      
         

No comments:

Post a Comment