Sunday, November 10, 2019



বর্ধমান জেলার প্রাচীন মসজিদ 
   ফিরোজ আলি কাঞ্চন


    বর্ধমান জেলার স্থাপত্য শিল্পের সাংস্কৃতিক নিদর্শনে যেমন প্রাচীন হিন্দু দেব মন্দির ও দেউল গুলির নান্দনিক সৌন্দর্য ঐতিহ্যমণ্ডিত,তেমনি আবার  বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন মসজিদ  গুলির গঠন শৈলীর বিশেষত্ব জেলার স্থাপত্যশিল্পের অধ্যায়কে করে তুলেছে আরও সমৃদ্ধ।মোঘল যুগে বর্ধমান জেলাকে বলা হতো ' সরিফাবাদ ',অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বসবাসের স্থান।আবুল ফজলের ' আইন-ই-আকবরী ' গ্রন্থে ষোড়শ শতকের শেষের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের সময় সমগ্র বাংলাকে ঊনিশটি সরকারে বিভক্ত করা হয়েছি,তার মধ্যে সরিফাবাদের অন্তর্ভুক্ত বর্ধমানের নাম উল্লেখিত।ভাগ্যান্বেষনে দিল্লীর  সুলতানদের জীবনের বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতে নিরাপদ আশ্রয়স্থান হয়ে উঠেছিল বর্ধমান।শাহজাহান থেকে শেরশাহ,নূর জাহান থেকে আজিম-উস-সান , ফারুকশির প্রভৃতি তৎকালীন রাজনীতির অনেক কেন্দ্রীয় চরিত্র দিল্লী থেকে বহু দূরে এ সরিফাবাদে এসে অবস্থান করেছিলেন।ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বর্ধমান জেলার বিভিন্ন স্থানে সেইসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপাসনাস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাধিক মসজিদ,মক্তব।আবার গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহ বা দিল্লীর সম্রাট গণ বর্ধমান জেলার বিভিন্ন পীর ওলি আওলিয়াগনের মাজারের নিকটে মসজিদ নির্মাণ ও পুকুর খনন করে দিয়েছিলেন।    
          অখণ্ড বর্ধমান জেলার প্রাচীন মসজিদ গুলি জেলার ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব সব নিদর্শন। শিল্পকলার বৈশিষ্টে মসজিদগুলিতে পারসিক শিল্পরীতির প্রভাব যেমন বিদ্যমাম তেমনি লক্ষনীয় ইসলামিক শিল্পরীতির  সঙ্গে গৌড়িয় শিল্পরীতির মিলন;এ ছাড়াও বেশকিছু প্রাচীন মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক কিছু চরিত্রের ঘটনা প্রসঙ্গ।বর্ধমান শহরে পুরাতনচকে,খক্কর সাহেবের মাজারের নিকট  ' কালো মসজিদ 'টি শেরশাহ ৯৫০ হিজ, ইংরাজি ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন, মসজিদে আজো রয়েছে শেরশাহের লিপি।হুমায়ুন শেরশাহের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে চুনার দুর্গ আক্রমণ করে সময়নষ্ট করতে থাকে,সেই সুযোগে শেরশাহ বর্ধমানে পালিয়ে এসে পরবর্তী পদক্ষেপের প্রস্তিতি নিতে থাকেন, পরে দিল্লীর ক্ষমতায়    অধিষ্ঠিত হয়ে এই মসজিদটি নির্মান করে দেন।সাহাচেতন পুরে পীরবাহারামের মাজার সৌধের সঙ্গে যুক্ত এক প্রাচীন মসজিদ।পীর বাহারাম ছিলেন সম্রাট আকবরের খুব শ্রদ্ধাভাজন, কিন্তু আবুল ফজলের তা অপছন্দ হলে পীর বিরক্ত হয়ে বর্ধমানে এসে যোগী জয়পালের আশ্রমে আশ্রয়   নিয়ে সাধনা করতে থাকেন,১৫৬৪খ্রিষ্টাব্দে এই সাধকের জীবনাবসান হলে আকবর পীর বাহারামের মাজার সৌধ নির্মাণ করেদেন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের  জন্য চারটি মৌজা দান করেছিলেন।আবার ঔরজ্ঞজেবের নাতি আজিম-উস-সান যখন  শোভা সিংহের দ্বারা মহারাজ কৃষ্ণরাম রায়ের হত্যার পর বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করার জন্য বর্ধমানে অবস্থান করেছিলেন তখন তিনি আলম গঞ্জে তিন গম্বুজ ওয়ালা মসজিদটি নির্মান করেন ১৬৯৯খ্রিষ্টাব্দে।
১৭ নম্বর ওয়ার্ডে নবাব বাড়ি বা খাজা আনোয়ার বেড়ের সমাধিক্ষেত্রের চত্বরে রয়েছে এক প্রাচীন মসজিদ।কৃষ্ণরাম রায়ের কণ্যা সত্যবতীর হাতে লম্পট শোভা সিংহের মৃত্যুর পর বিদ্রোহী দলের লাগাম চলেযায় পাঠান রহিম খাঁর হাতে,এই রহিম খাঁর বিশ্বাস ঘাতকতায় আজিম-উস-সানের উজির খাজা আনোয়ারের মর্মান্তিক মৃত্যুকে স্মরণ করে ফারুক শিয়র এই মসজিদ ও সামাধি সৌধস্থল নির্মান করেন।আবার ফারুক শিয়র তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু সুফি বায়াজিদের সম্মানে কালনা রোডে প্রতিষ্ঠা করেন বন-মসজিদ।
বর্ধমানে অবস্থানকালে আজিম-উস-শানের সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই পুত্র করিম উদ্দিন ও ফারুক শিয়র।একদিন তিনি দুই পুত্রকে পাঠালেন জীন্দাপীর হজরত বায়াজিদের কাছে দোয়া প্রার্থনার জন্য।প্রচলিত আছে পীরের সাধন কক্ষে আজিম-উস-সানের দুই পুত্রের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হজরত বায়াজিদ তাদের প্রতি সালাম জানিয়ে বললেন,'আসসালামু আলাইকুম ' অর্থাৎ  আপনার/আপনাদের উপর প্রভুর করুণা বর্ষিত হোক।কিন্তু তার প্রত্যুত্তরে করিম উদ্দিন দিলেন না,রাজকীয় গাম্ভীর্যে তিনি নীরব থাকলেন;তবে ফারুকশিয়র ' ওয়া আলাইকুম আসসালাম ' অর্থাৎ আপনার উপরেও প্রভুর করুণা বর্ষিত হোক ' বলে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আদব কায়দার সাথে পীরকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদান করলেন।সুফি বায়াজিদ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন 'হিন্দুস্থানের ভাবি সম্রাট বসুন ',কিন্তু এবারেও করিমউদ্দিন গাম্ভীর্যের সাথে দাঁড়িয়ে থাকলেন,কন্তু ফারুক শিয়র আসন গ্রহন করলেন,আর এখানেই যেন তিনি পীরের আশির্বাদ পেয়েগেলেন,ইতিহাস সাক্ষী১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনিই বসেছিলেন সিংহাসনে।সম্রাট হয়েও ফারুক শিয়র ভুলে যাননি তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু সুফি বায়াজিদের কথা,তিনি অস্তানায় একটি মসজিদ তৈরী করেদেন।বর্ধমান কালনা রোডের ধারে অবস্থিত এই মসজিদটি বর্তমানে বন মসজিদ নামে পরিচিত

    বর্ধমানের মূল শহরে অবস্থিত আরো অসংখ্য প্রাচীন মসজিদ গুলির মধ্যে অন্যতম ইছলাবাদে ১১১৫ হিজরি, ইংরাজি১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত তিন গম্বুজ ওয়ালা মসজিদ,বি.সি.রোডে পায়রাখানা গলিতে অবস্থিত প্রাচীন 'নূর মসজিদ ',কাটরা পোতার প্রাচীন তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ,তেঁতুল তলা বাজারে প্রাচীন ' মদিনা মসজিদ ',রাধানগর পাড়ায় ' মক্কা মসজিদ ',গোদা অঞ্চলে ' সান মসজিদ ' ও একটি এক গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,পুরাতন চকে 'কালো খা মসজিদ',এছাড়াও শহরের ছোট নীলপুর ,তেজ গঞ্জ,কমল সায়ের,মির ছবা,গোলাপ বাগের হাজিপোতা,কেশবগঞ্জ চটি প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাচীন মসজিদ রয়েছে।
     অজয় নদের তীরে প্রাচীন জনপদ মঙ্গল কোটে  পীর হামিদ বাঙালীর মাজারের নিকট অবস্থিত বারো দরওয়াজা মসজিদটিও বিখ্যাত।সিংহাসন লাভের পূর্বে শাহজাহান পিতার সঙ্গে মনোমালিন্য  করে মঙ্গলকোটে এসে আত্মগোপন করে ছিলেন,এখানে আধ্যাত্মিক সুফি সাধক মৌলানা হামিদ দানেশমন্দের সান্নিধ্য তিনি লাভ করেন,এই সাধক বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজেকে 'বাঙালী ' পরিচয় দিতেন।পরে সম্রাট হয়ে শাজাহান ৯৪হাজার স্বর্ণ মূদ্রা ব্যয়ে  মসজিদটি ১৬৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণকরে দেন। মঙ্গল কোটের দাঁই হাটে  মাটির স্তুপের উপর প্রস্তর খণ্ডে নির্মিত ফুল,লতা পাতার নক্সাযুক্ত ভগ্ন মসজিদটি হুসেন শাহ নির্মিত,এ ছাড়াও রয়েছে ১৭১৭খ্রিষ্টাব্দে শাহ আলম খান প্রতিষ্ঠিত ছয় গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,বাদশাহি সড়কের ধারে  বায়খা ও কুলটি গ্রামের প্রাচীন মসজিদ দুটি হুসেন শাহের আমলে নির্মিত।
  কালনা অঞ্চলে টেরাকোটা ভাস্কর্যযুক্ত মসজিদ-ই-জামিয়া ১৫৩৩  খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন ফিরোজ শার কালে উলুঘ মুসুয়ানী খান নির্মান করেনদাঁতন কাঠি তলা নামক স্থানে।এ ছাড়াও এখানে রয়েছে ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আবুল মুজাফফর বাহাদুর শাহের নির্মিত মসজিদ,বদর সাহেবের মসজিদ,১৪৯০খ্রিষ্টাব্দে মামুদ শাহের রাজত্বকালে মজলিস সাহেবের মসজিদ, শাসপুর-দিঘীর পাড়ে আছে হাবসি রাজাদের আমালের প্রাচীন মসজিদ, পূর্বস্থলীর জাহাননগরের জাহান আলি খানের সময়ের প্রাচীন মসজিদ ইত্যাদি।
   কাটোয়ার বাগান পাড়ায় চার মিনার ও ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট প্রাচীন মসজিদটি শাহ আলমের আমলে নির্মিত,ভাতার থানা অঞ্চলের কালুত্তক গ্রামে হজরত কালুত্তক সাহেবের মাজারের নিকট প্রাচীন মসজিদটি হুসেন শাহ প্রতিষ্ঠা করেন।আউসগ্রামের সুয়াতায় পীর বাহমান সাহেবের মাজারের নিকট হুসেন শাহ একটি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়ে ছিলেন, যদিও বর্তমানে তা নিশ্চিহ্ন।সাহিত্য বিনোদ আয়ুব হোসেন আবিস্কৃত 'মৃগাবতী' কাব্যের পুঁথির লেখক আব্দুল আলিম ছিলেন সুয়াতার এই পীরের মাজারের খাদেম বা সেবক,তাঁর সময়সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ হজরত শাহ মাহামুদ বাহামানীর মাজারে কবর জিয়ারত করতে আসেন;তখন তিনি সুলতানকে শুনিয়েছিলেন মৃগাবতী কাহিনীর রুপকথা।মুগ্ধ হয়ে সুলতান খাদেম আব্দুল আলিমকে কাব্য রচনার আদেশ দেন,এবং পীরের মাজার বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন ও একটি মসজিদ নির্মান করে দিয়েছিলেন,'রাজ বন্দনা ' অংশে কবি লিখেছেন-"মহামতি হুসেন শাহ বড়া সুলতান/পঞ্চগৌড় জিনিয়া গৌড়ের প্রধান।/...সুয়াতা গাঁয়েতে আছে পীর বাহামান,/মাজার বাঁধাল রাজা জমি দিল দান।/মাজারের উত্তরে ভালকী নগর/মসজিদ রচিল সেথা অতি মনোহর।

   কেতুগ্রামের নরসিংহপুর ও কুলুট গ্রামে রয়েছে প্রাচীন মসজিদ,বেলওয়ারী গ্রামের মসজিদে চুন বালির আস্তরনে অলংকরণ খুবই সুন্দর।মালডাঙ্গার  বোহার গ্রামেও প্রাচীন মসজিদ দেখাযায়,কুলুইতি গ্রামের  মাটির খিলানের প্রাচীন মসজিদটি  উনিশ শতকের।ভাতার অঞ্চলের এরুয়া গ্রামে রয়েছে পাঁচটি প্রাচীন মসজিদ।পূর্বস্থলির মেড়তলা গ্রামে তালপাতা  পাড়ায় আছে এক প্রাচীন মসজিদ,  আউস গ্রামের  সর গ্রামের পাঠান পাড়ায় এক গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,দিগনগর গ্রামে ভগ্ন প্রায় পাঁচশত বছরের প্রাচীন মসজিদ,বুদবুদের মারো কোটা গ্রামে প্রাচীন মজ্জিদের ধ্বংসাবাশেষ ও তার নিকটেই এক গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,গলসি অঞ্চলের আদড়াহাটি,জাগুলপাড়া,মসিদপুর,সরমারো-কোটাগ্রামের প্রাচীন মসজিদ ও ভুড়ি গ্রামের প্রাচীন মসজিদের ভগ্নাবশেষ জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসে বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
    সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালীর ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন,সেই আক্ষেপ যেন আজো আমাদের রয়েগেল।জেলার ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন মসজিদ গুলির বেশিরভাগই বর্তমানে ধ্বংসপ্রায় বা সংস্কারের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে,শুধু মসজিদ নয়,জেলার অনেক প্রাচীন মন্দির,দেউল, বা কবি লেখক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী দের স্মৃতি বিজরিত স্থানগুলি আজ অবহেলা ও উদাসীনতায় প্রচারের অন্তরালে থেকে যেন শেষ অস্তিত্বটুকু নিয়ে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার অপেক্ষায়।অথচ এগুলির ঐতিহ্যের সঠিক অনুসন্ধান ছাড়া বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসের পরিপূর্ণতা অসম্ভব।
----------------------_----
লেখক শিক্ষক,গলসি আঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মি
ছবিঃ
নতুনহাটে হুসেনশাহী মসজিদের ধ্বংসাবশেষ ২টিছবি

গোলাপবাগে হাজিপোতা মসজিদ

গলসি জাগুলিপাড়া গ্রামের প্রাচীন মসজিদ

বাহির সর্বমঙ্গলাপাড়ার জামা মসজিদ



  ৷৷ ৷৷৷৷  মঙ্গোল কোটে হুসেন শাহী মসজিদ।।।
৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷  বর্ধমান গোলাপবাগে হাজিপোতা মসজিদ।।।।


No comments:

Post a Comment