Sunday, November 10, 2019

বর্ধমান জেলায় মহরম


শোকের আবহে শান্তির বার্তায় মহরম

                          ফিরোজ আলী কাঞ্চন


মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মূলত কোন বিভাগ না থাকলেও হজরত মহম্মদের(সাঃ)পরলোক গমনের পর ইসলাম ধর্ম সুন্নী ও শিয়া এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।সুন্নীর অর্থ সুন্নতের অধিকারী,যাঁরা নবিজীর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ  করে তাঁরাই সুন্নী।বাংলার তথা ভারত বা পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ মুসলমানই সুন্নী মতাবলম্বী।আর শিয়া শব্দের অর্থ দল।হজরত মহম্মদের(সাঃ) ইন্তেকালের পর খলিফা কে হবেন এই নিয়ে বিতর্ক দেখাযায়,নবিজীর জামাতা হজরত আলিকে  খলিফা হিসেবে সমর্থন করে শিয়া দলের উৎপত্তি।ইরাক,ইরান শিয়া অধ্যুষিত দেশ,ভারতের মুসলিমরা সুন্নি প্রাধান্য হলেও কিছু সংখ্যক শিয়া মতাবাদী মুসলিমও রয়েছে,হায়দ্রাবাদের সুলতান টিপুর বংশ,জিন্নাহ,বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা প্রমুখগণ শিয়া ছিলেন।
     
   শিয়া ও সুন্নী উভয় মতাবলম্বী গণের কাছেই মহরমের গুরুত্ব অপরিসীম।পবিত্র কোরান অনুসারে আরবি বারোটি মাসের মধ্যে যে চারটি মাস আল্লাহ তলার কাছে সবচেয়ে সম্মানিত তার মধ্যে অন্যতম মহরম মাস।'মহরম ' প্রকৃতপক্ষে একটি মাসের নাম,তবে শিয়া ও সুন্নীদের কাছে এমাসের গুরত্ব আলাদা আলাদা।সুন্নীরা এ মাসে রোজা রাখে,দান-খয়রাত করে থাকে,অপরদিকে শিয়ারা রোজা রাখা বা দান খয়রাতের সাথে সাথে মহরমে তাজিয়া,লাঠিখেলা,মর্সিয়া গাওয়া ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেথাকে,যা সুন্নীরা পছন্দ করেন না।স্বাভাবিক ভাবে সচেতন পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেপারে আমাদের এখানের মুসলিমরা সুন্নী হয়েও মহরমে তাজিয়া বেরকরে, মর্ছিয়া গায় বা লাঠিখেলে কেন?আসলে এখানেই লুকায়িত আছে বাংলার সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাটি,যা সকলকে আপন করে নেওয়ার।বাঙলায় ইসলামের আগমন ঘটেছে মূলত ইরান পারস্য হতে আগত পীর ওলী আউলিয়াদের মাধ্যমে,আর এই পীর আউলিয়ারা বাংলায় এসে এখানের সংস্কৃতির সজ্ঞে যেন মিশে গিয়েছিলেন।এ প্রসঙ্গে বলতে হয় মঙ্গলকোটের পীর হামিদ বাঙালীর কথা,সম্রাট শাহজাহানের আধ্যাত্মীক এই গুরু সুদূর পারস্য থেকে  এসে মঙ্গলকোটে আস্তানা গড়েছিলেন।প্রকৃত নাম ছিল হামিদ দানেশাখন্দ,কিন্তু তিনি ক্রমে বাংলাকে ভালোবেসে,বাংলার মাটি জল হাওয়ার সাথে গভীর একাত্মতাবোধে নিজেকে ' বাঙালী ' পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন।তাইতো এইসব মহান ওলী আউলিয়াদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম এদেশে এসে হয়েউঠেছিল অনেক উদার।এখানের মুসলিমরা একদিকে যেমন শিয়া ও সুন্নীর সমন্বয় সাধন ঘটিয়েছে,তেমনি আবার বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যের ধারাকেও বজায়রেখেছে।আর নবিজীর আদর্শ ছিল এটাই,তিনি আরবের পূর্ব বর্তী সমস্ত জনজাতিকে নিয়ে এক অখণ্ড মানবতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, হজরত মহম্মদ (সাঃ) আমাদের দেশে আসতে পারেননি কিন্তু আরব,ইরান,পারস্যথেকে এই পীর আউলিয়াগণ সেই মানবতার বাণীই এখানে এনে যেন পৌছে দিলেন,সেই সূত্র ধরেই সুন্নী প্রধান এদেশেও মহরম মানে রোজা,দান ধ্যানের পাশাপাশি ' হায় -হোসেন, হায় -হোসেন 'প্রলাপে বুকফাটা ক্রন্দন।

'মহরম ' আরবি শব্দ,এর অর্থ পবিত্র বা সম্মানিত।ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাসের নাম মহরম।বিশ্বাস অনুযায়ী এ মাসে পরম প্রভু আল্লাহতালা এই বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন,এই মাসে আদি পিতা হজরত আদম কে সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই মাসেই স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে পৃথিবীতে পতিত হয়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর   আদিপিতা আদম ও মা হাওয়া পরস্পরকে দেখাপেয়েছিলেন;এছাড়া আরো একাধিক ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ৬১হিজরী ১০ই মহরম- আশুরার দিন কারবালার প্রান্তরে এজিদ বাহিনীর হাতে ইমাম হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যুর কাহিনী;এই বিষাদ গাঁথাকে স্মরণ করে মুসলিম সমাজ পরম ভক্তিভরে পালন করে থাকে শোকের পরব মহরম।
       মহরমের দিন রোজা রাখা হয়,গরিব মিসকিনদের বিতরন করা হয় চালের আটার পিঠে,হালুয়া সুজি,কোথাও পথিকদের জল পান করানো হয়,কোথাও বেরকরা হয় তাজিয়া,লাঠি খেলা হয়,মর্সিয়া গাওয়া হয়।হাসান,হোসেনের করুণ গাঁথাকে গাইতে থাকে মূল গায়ক আর বাকীরা বুক চাপড়ে বলতে থাকে ' হায় হোসেন,হায় হায়!!'।অনেকে আবার হাতের আঙুলের মাঝে রাখে ব্লেট আবার অনেকে পিঠি মারতে থাকে খঞ্জর। 
  কারবালার এই হৃদয়বিদারক কাহিনি অবলম্বনে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ' মহরম' কবিতা-"মহরম ! কারবালা ! কাঁদো হায় হোসেনা ! / দেখো  মরু - সূর্য এ খুন যেন শোষে না।"কবিতাটি ' মোসলেম ভারত ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।মহরমের মর্সিয়ার করুন সুর যেন হৃদয় কে স্পর্শ করে।'মর্সিয়া' আরবি শব্দ,যার অর্থ শোক পেকাশ।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অনেক কবি ফারসি ও উর্দু মর্সিয়ার ভাবধারা অবলম্বনে বাংলা মর্সিয়া রচনা করে নিজস্ব স্বতন্ত্রতার পরিচয় দিয়েছেন,এঁদের মধ্যে হামিদুল্লাহ,মোহম্মদ খান,শাহ গরীবুল্লাহ,হিন্দু কবি রাধামোহন গোপ,মীর মোশাররফ হোসেন,হামিদ আলী,কায়কোবাদ,শেখ ফয়জুল্লা প্রমুখগণ উল্লেখ্যোগ্য।

       পূর্বেই বলা হয়েছে মুসলিম সমাজের আবার একটা অংশ এই লাঠি খেলা,তাজিয়া বেরকরা,মর্সিয়া গাওয়া বা খঞ্জর চালানোর বিরোধী,আর এক পক্ষ্য বলে মর্সিয়া গেয়ে,লাঠি খেলে,ধারালো খঞ্জরের আঘাতে রক্ত ঝরিয়ে যেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার সজ্ঞে নিজেদের একাত্মতা অনুভূত হয়েথাকে।ধু ধু মরু প্রান্তরে হোসেন পুত্র আলী আসগর একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করতে থাকে,পিতার কাছে কচি সেই প্রাণ আধো আধো স্বরে বলতে থাকে ' আল-আৎশ!', ' আল-আৎশ!! ' অর্থাৎ পিপাসা,পিপাসা।চারিদিকে শত্রু সৈন্যে আবদ্ধ হোসেন নিজের জিহ্বা পুত্রের মুখে পুরে দিলেন,কিন্তু তাতে কি আর গলা ভিজে?দুধের শিশুকে কোলে তুলে হোসেন বাইরে বেড়িয়ে শত্রু সৈন্যদের কাছে শুধু পুত্রের জন্য একটু জলের প্রার্থনা জানালেন,বিনিময়ে ছুটে এলো তীর,বিদ্ধ আসগর কে ফিরিয়ে নিয়ে এসে হোসেন স্ত্রীর কোলে তুলে দিয়ে বললেন,'এই নাও তোমার পুত্র,ওর সারা জীবনের মতো তৃষ্টা মিটে গেছে,ও আর কোনদিন পিপাসা পিপাসা বলবে না।'এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া সাখাওত হোসেন লিখেছেন," এই যে মহরমের নিশান,তাজিয়া প্রভৃতি দেখা যায়,ঢাক ঢোল বাজে,লোকে ছুটাছুটি করে,ইহাই কি মহরম?...আচ্ছা তাহাই হউক;ঐ নিশান তাজিয়া লইয়া খেলাই হউক; কিন্তু ঐ দৃশ্য কি একটা পুরাতন শোক স্মৃতি জাগাইয়া দেয় না?বায়ু হিল্লোলে নিশানের কাপড় আন্দোলিত হইলে তাহাতে কি স্পষ্ট লেখা দেখা যায় না- 'পিপাসা '? "
           বর্ধমান জেলার  আসানসোল, বার্ণপুর,রাণীগঞ্জ,জামালপুর,কালনা,কাটোয়া,গলসির খেতুড়া,দয়ালপুর,দরবাপুর,বাহিরঘন্না সহ বিভিন্ন অঞ্চলে মহরমের তাজিয়া বের হয়ে থাকে,মূল বর্ধমান শহরে বি সি রোডে এক বিশাল শোক মিছিল বেড় হয়,কালাপাড়ি পীরের আস্তানা থেকে ঢাল বের হয়ে পুরো শহর পরিক্রমা করে। এ ছাড়াও পুরাতন চক, দুবরাজ দিঘী,ছোট নীল পুর,কুরমুন  চন্দনপুর, খাজা আনোয়ার বেড় এলাকা থেকেও ঢাল বের হয়ে থাকে।কয়েক বছর  আগে দূর্গাপুজো ও মহরম একই সময়ে পড়েছিল,গলসির চৌমাথার স্টার ক্লাবের পুজোমণ্ডপে খেতুড়া,বাহিরঘন্না গ্রামের ছেলেরা মহরমের মর্সিয়া গেয়ে এক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।আবার সে বছর পুজো ও মহরম এক সঙ্গে হওয়ায় ঢাক ঢোল বাজনা নিজেদের মধ্যে ভাগকরে নিয়েছিলেন ভাতারের এরুয়ার কাজীপাড়ার মহরম কমিটি ও স্থানীয় পুজো কমিটির সদস্যগণ।আউস গ্রাম অঞ্চলের সিলুট বসন্তপুর গ্রামে মহরমে নাটক,যাত্রা,কবিতা আবৃতি,গজল,কেরাতপাঠের আয়োজন করা হয়ে থাকে।কয়রাপুর গ্রামে  মহরমে বিশেষ কিছু রীতি পালন করা হয়,গ্রামের বাছায় দশ জন ব্যক্তি ব্রত পালন করে থাকে,মহরমের চাঁদ উঠার এক দিন পর এই দশজনে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে মজ্ঞল কোটে গিয়ে সেখানে আধ্যাত্মিক গুরু ছোট হুজুরের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে এসে মজ্ঞলকোটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পীর আউলিয়ার মাজার পরিক্রমা করে আবার অন্যপথে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরে এসে অবস্থান করে ইমামতলায়,এই ইমাম তলা হলো হাসান হোসেনের কল্পিত মাজার,এই কয়েকদিন ১০ই মহরম পর্যন্ত এই পালনকারীদের বাড়ির সজ্ঞে কোন সম্পর্ক থাকে না,এরা রোজারেখে থাকে,চুল, দাড়ি,নখ কাটা এই সময় গুলিতে নিষিদ্ধ;মহরমের দিন জ্বলন্ত আজ্ঞারের উপর  দিয়ে হেটে আগুন মাতম করা হয়ে থাকে।অনেক মুসলিম প্রধান গ্রামে আছে ইমামতলা,মহরম শেষে তাজিয়া এনে ইমাম তলায় রাখাহয়।

 এভাবে শোকের আবহে ধর্মীয় আধ্যাত্মীকতার সাথে সাথে শান্তির দৃষ্টান্ত রেখেছে মহরম।
                          -
লেখক গলসির শিক্ষক,সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মি

ছবি
গলসির খেতুরা গ্রামে মহরমের ইমামতলা


বর্ধমান জেলায় তন্ত্রসাধনার ধারায় কিছু ঐতিহ্য

    ফিরোজ আলি কাঞ্চন
  


প্রাচীন ভারতের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় উপাসনাপদ্ধতি হলো তন্ত্র সাধনা,যার তৎপত্তি বেদ হতে।তন্ত্র সাধনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন ধারারমধ্যে উল্লেখযোগ্য শাক্ত সম্প্রদায়।
তন্ত্রসাধনায় শক্তি নিরাকার,তিনি নারীও নন পুরুষও নন।তবে তন্ত্র সাধকদের সুবিদার্থে শক্তির রুপ কল্পনায় কখনো তিনি পুরুষ কখনোবা নারী।এই তন্ত্রসাধনার ধারায় নারীরুপে ইষ্ট দেবীদের মধ্যে কালী,তারা,জগদ্বাত্রী বিভিন্ন নামের রুপে তিনি পূজিত হন।দশ মহাবিদ্যার অন্যতম  মহাশক্তি দেবী কালীর বিভিন্ন নাম--সিদ্ধেশ্বরী,বুড়িমা,ডাকাত কালী,ক্ষ্যাপা মা,আনন্দময়ী,মা দক্ষিণা কালী,ভদ্রাকালী,সিদ্ধ কালী,গুহ্যকালী,শ্মশানকালী,মহাকালী,রক্ষ্যাকালী,চামুণ্ডা,রুদ্রকলী,মুক্তকেশী,করালী,কালরাত্রী,কপালিনী ইত্যাদি।

         রাঢ়বঙ্গ তন্ত্রসাধনার উল্লেখ্যোগ্য পীঠস্থান,তন্ত্রসাধনার একান্নোটি পীঠের মধ্যে নয়টি পীঠের অবস্থান এখানে।এই রাঢ়বঙ্গের মধ্যমণি বর্ধমান জেলার বিভিন্ন স্থান এই তন্ত্রসাধনার তীর্থস্থান রুপে পরিগণিত।নতুনহাটের নিকট উজানি কোগ্রামে মঙ্গলচণ্ডী,ক্ষীরগ্রামে দেবী যোগ্যদা,কেতুগ্রামে বহুলা মহাপীঠ,আউসগ্রামের অমরারগড়ে দেবী শিবাখ্যা,কাটোয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালী,মন্তেশ্বরের করন্দা গ্রামে করন্দেশ্বরী,বরাকরের কল্যাণেশ্বরী,ভাতারের বড়বেলুনের বড়ো মা প্রভৃতি জেলার উল্লেখযোগ্য তন্ত্রসাধনায় পূজিত আরাধ্য দেবী।এ ছাড়াও মেমারীর আদম পুরের কালী চার বোন-বড় মা,মেজ মা,সেজ মা,ছোট মা।এই গ্রামে দেবীর পুজা প্রায় পাঁচশো বছরের প্রাচীন, দুর্গাপুরে সিটি সেন্টারের প্রাচীন মন্দিরে  দেবী চৌধুরানী ও ভবানীপাঠক দেবীকে ভারতমাতা রুপে উপাসনা করেছেন,তন্ত্রসাধনার সাথে দেশপ্রেমের এমনধারা মেলবন্ধন ব্যতিক্রমী। মন্তেশ্বরের শুশুনিয়ায় রয়েছে চারশো বছর ধরে পূজিত দেবী তারাক্ষ্যা,বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র দেবীর পুজোর জন্য ২৫২ বিঘা জমি দান করেছিলেন।আবার জৈন্য ধর্মের দেবী অম্বিকার সঙ্গে শাক্ত দেবী মিশে গেছে কালনার বামা কালী বা সিদ্ধেশ্বরীতে,দেবীর বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেদেন বর্ধমানের মহারাজা চিত্রসেন।

       মূল বর্ধমান শহরে কাঞ্চন নগরর গোবিন্দ দাসের জন্মস্থানের নিকট আছেন কঙ্কালেশ্বরী,দেবীর মূর্তিটি এখানে বড়ো অদ্ভূত-মানবদেহের শিরা উপশিরা খোদাইকৃত কষ্ঠি পাথরের অষ্টভূজা মৃতিটির নান্দনিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। ১৯২৩ সালে দামোদর নদথেকে মূর্তিটা উদ্ধার হয়।রাজবাটির নিকট মহারাজা তেজচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত সোনার কালী,তেজগঞ্জে বিদ্যাসুন্দর কালী,কমলাকান্ত কালী,দুর্লভা কালী প্রভৃতি শহরের ঐতিহ্যবাহী কালী মন্দির।

   তবে অখণ্ড বর্ধমানে উচ্চতার নিরিখে যে দুই কালী খুবই জনপ্রিয় ও বিখ্যাত তার একটি হলো ভাতার অঞ্চলের বড়বেলুনে বড়মা।প্রায় আঠারো হাত উচ্চ বিশালাকার দেবীমূর্তির জিহ্বা তৈরী হয় নতুন কুলো কেটে,আজথেকে ছয়শত বছর আগে গোঁসাই ভৃগুরাম নামক এক সাধক এই দেবীর পূজোর সূচনা করেন।অন্য বিখ্যাত দেবী হলেন তকীপুর গ্রামের বড় কালী

      তকীপুরের বড় মাঃ

'ঠাকুর আর পুকুর/এই নিয়ে তকীপুর।  জেলার শক্তিসাধনায় আউসগ্রাম থানা অঞ্চলের  প্রাচীন জনপদ তকীপুর গ্রাম এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।বহু পূর্বে এই স্থান ছিল ঘন বেত বনের গভীর জজ্ঞল,আর সে জজ্ঞল ছিল ঠ্যাঙারে ডাকাতদের অবাধ বিচরনক্ষেত্র।গ্রামের উত্তর প্রান্তে যে মহাশ্মশান ছিল,সেখানে ডাকাতের দল ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে গভীর রাতে মশাল জ্বালিয়ে এসে কালীর সাধনা করে তবে ডাকাতি করতে যেত।সে প্রায় ৬০০ বছর আগের কথা।পরে বর্ধমান মহারাজের উদ্যোগে নির্মিতি হয় বর্তমান মন্দিরটি।
         মন্দিরে নিত্য পূজা দেওয়া হয়,তবে প্রতি সপ্তাহে শনি ও মজ্ঞলবার দেবীর বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।কালীপূজার সময় দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরী করা প্রায় ১৫-২০ফুট উচ্চতার।এই সময় দেবীর পূজার কিছু ব্যতিক্রমী রীতি চোখে পড়ে,মাঝ রাত্রিতে পুরোহিত দেবীর চক্ষুদান করে থাকেন,চক্ষুদান করার পরেই তিনি সোজা বাড়ি ফিরে যান,তখন মশাল জ্বালিয়ে পুরোহিত মশায়কে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসা হয়।আমাবস্যার ভোর বেলায় দেবীর ঘট আনা হয়,তার পর দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।বলিদান দেওয়া হয় সকালে,হোম হয়,প্রতিদিন নিয়ম মেনে ঘট আনা হয়,আবার পুজোর পর সে ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। এই ভাবে  পঞ্চমী পর্যন্ত পূজা চলে।এ প্রসজ্ঞে উল্লেখ্য দেবীর নিজস্ব কম-বেশী  প্রায় ২৭-২৮ ভরি রুপো এবং ৭-৮ভরি সোনার গহনা আছে।এই গহনা পূজা কমিটির মধ্যস্থতায় সারা বছর ব্যাংকের লকারে গচ্ছিত থাকে,পূজার সময় লকার থেকে বেড়করে এনে স্যাকারার কাছে নিয়ে গিয়ে পালিশ করে এনে দেবীকে পরানো হয়ে থাকে,পূজার পর আবার তা নিরাপদে ব্যাংকের লকারে রেখে আসা হয়।
          মন্দিরে বলিদানের প্রথা খুব প্রাচীন।।শোনাযায় সেই ডাকারদের আমলে নাকি এই দেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়া হতো।পরে শুকরও বলি দেওয়ার চল ছিল,তবে তা এখন হয় না।বর্তমানে মোষ,পাঠা,ভেড়া বলি দেওয়া হয়ে থাকে।এই বলির সময় হাজার হাজার ভক্তের সমাগমে মন্দির প্রাজ্ঞন মুখরিত হয়ে থাকে।
              এই দেবী বড়ো জাগ্রত।দেবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে তকীপুর গ্রামবাসীর মধ্যে কিছু প্রথার প্রচলন আছে,যেমন ' নুন পালা 'প্রথা;এই প্রথার নিয়ম অনুযায়ী কোন এক বিশেষ দিনে গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে সেদিন নুন ছাড়া রান্না করা হয়ে থাকে।
             এই বড় কালীর পূজা উপলক্ষে এক বিরাট মেলা বসে।তকিপুর সংলগ্ন ভোতা,বিল্বগ্রাম,সর,দিগনগর,বাহিরঘন্না,আসকরন,কুরকুবা,গলসী,খেতুড়া,বাবলা,বৈচি প্রভৃতি গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হন। বাড়িতে বাড়িতে কুটুম আসে।তকীপুর  গ্রামের বহু পরিবার কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন,এই পূজার কটাদিন দেবীর টানে সেই পরিবার গুলোও যেন গ্রামের মাটিতে ফিরে আসেন।হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তকীপুরের কালীপুজোর মেলা এই অঞ্চলের সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয়।

চান্নাগ্রামে সাধক কমলাকান্ত পূজিত দেবী বিশালাক্ষীঃ



           যদিও আনুমানিক ১১১৭ সালে(ইং-১৭৭০খ্রিঃ)অম্বিকা কালনায় বাংলা শাক্তপদাবলির অন্যতম কবি সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য জন্ম গ্রহন করেন,কিন্তু অকালে পিতা মহেশ্বর ভট্টাচার্য্যের মৃত্যু হওয়ায় মাতা মহামায়াদেবী তাঁর দুই সন্তান কমললাকান্ত ও শ্যামকান্তকে নিয়ে চলে আসেন বাপের বাড়ি গলসীর চান্না গ্রামে।মামা নারায়ণ ভট্টাচার্য্য এঁদের বেশকিছু জমি গবাদি পশু প্রদান করেন।কবির পৈতে দিয়েছিলেন এই মামা নারায়ণ ভট্টাচার্য্য।কমলাকান্তের ' সাধকরঞ্জন ' গ্রন্থে পাওয়া যায়--


          ' অতপর কহিশুন আত্মনিবেদন।


           ব্রাম্ভণ কূলে উপনীত স্বামী নারায়ণ।'


              এই সময়য় চান্না গ্রাম ছিল শিক্ষা দীক্ষ্যার পীঠস্থান।কমলাকান্ত গ্রামের টোলে ব্যাকরণ শাস্ত্র অধ্যায়ন করেনে এবং পরে তিনি নিজে একটি টোল প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাপনা করতে থাকেন।কমলাকান্ত অবসর সময়ে গ্রামের মেঠো পথে উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াতেন।পুত্রের সংসারের প্রতি উদাসীনতা দেখে মাতা মহামায়াদেবী কমলাকান্তের বিবাহ দিয়েদেন বর্ধমানের লাকুড্ডিতে ভট্টাচার্য্য পরিবারে।


                বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও সংসারী হতে পারলেন না কমলাকান্ত।সর্বদা গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দিরে উদাস মনে বসে থেকে ' মা-মা ' বলে ডাকতেন।মন্দির সংলগ্ন পুকুরপাড়ে বায়ুকোণে এক পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে সাধনায় মগ্ন থাকতেন।সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে কমলাকান্তের খ্যাতি বহুদূর ছড়িয়ে পড়ল।এদিকে দারিদ্র যেন নিত্য সজ্ঞী,সংসারে অভাব যেন দিনের দিন বেড়েই চলল।সাধকের এক অবস্থাসম্পন্ন ধনী ভক্ত চান্নায় এসে গুরুর আর্থিক দুরাবস্থা দেখে আবার কালনায় নিয়ে যান।সেখানেও কবি এক পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনা শুরু করেন।কিন্তু এখানের অবস্থান সুখকর হয় না,কিছুদিনের মধ্যেই মাতা মহায়াদেবীর মৃত্যু ঘটে।কবি ফিরে আসেন চান্নায়,এখানে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই আবার এক দুর্ঘটনা,বিপত্নীক হন কবি।


         কমলাকান্ত দ্বিতীয় বিবাহ করেন কাঞ্চন নগরে,এই স্ত্রীর গর্ভে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।দারিদ্র তবুও যেন পিছু ছাড়ে না,সবদিন চালও জুটটো না,এমনই এক অভাবের দিনে এক শ্যাম বর্ণা মহিলা সাধকের বাড়িতে হাজির,সজ্ঞে দুই লম্বা চওড়া লোকের মাথায় ঝুড়ি ভর্তি চাল,আলু তরিতরকারী।কমলাকান্তর চান্না অভস্থান কালে প্রচলিত আছে এমনি সব কাহিনী।আরো প্রচলিতলিত আছে যে বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরের পুজোয় শোল ও মাগুর মাছ লাগবেই,কিন্তু কোথাও মাছ পাওয়া যাচ্ছে না,এমন সময় শুনলেন পাশের পুকুরে জলের থেকে কারো উঠে আসার শব্দ,দেখলেন এল কালো কুচকুচে মেয়ে মাছ নিয়ে হাজির,হাসতে হাসতে বললো, ' আমি বাগদি পাড়ার মেয়ে গো,শুনলাম পুজোর জন্য তুমি কোথাও মাছ পাচ্ছো না,তাই দিতে এলাম,'।সাধক বললো,' কিন্তু আমার কাছে যে এখন পয়সা যে নেই মা ',বাগদি মেয়ে বললো,' সে তুমি কাল পাড়ায় দিয়ে এসো।'পরের দিন সারা বাগদি পাড়া তন্ন তন্ন করেও সেই কন্যার দেখা পাওয়া যায়নি।


           সাধক কমলাকান্তের মহিমার কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকলো দিকে দিকে।দেওয়ান রঘুনাথ রায়ের পরামর্শে বর্ধমানের মহারাজ তেজচাঁদ তাঁর রাজসভার সভাকবি রুপে নিযুক্ত করেন সাধক কবি কমলাকান্তকে।মহারাজ কমলাকান্তকে কোলাহাটে একটা মায়ের মন্দির নির্মান করেদেন এবং বাৎসরিক বৃত্তির বন্দোবস্ত করেদেন।সাধকের জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের।


কোলসড়া গ্রামে শেরশাহ পৃষ্ঠপোষকতায় সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরঃ

            জামালপুরের কোলসড়া গ্রামের ঘোষাল পরিবারের একাদশতম পূর্বপুরুষ দিগম্বর ঘোষাল আদিতে ছিলেন জম্মু কাশ্মীরের বাসীন্দা ও সম্রাট শের শাহের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী।শের শাহ তখন জি টি রোড নির্মানের পরিকল্পনার বাস্তবায়নে মগ্ন,আর তাঁর এই পরিকল্পনার তদারকির দায়ীত্বে আছেন দিগম্বর ঘোষাল। জি টি রোডের কাজ কর্ম দেখাশুনার জন্য দিগম্বর ঘোষাল একদিন কংসা নদীর তীরে রাত্রি বাসের সময় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেলেন।ধর্মভীরু দিগম্বর ঘোষাল তাঁর স্বপ্নাদেশের কথা সম্রাট কে জানালে শের শাহ দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা ও ব্যায় ভার পরিচালনার জন্য পাঁচ শত বিঘা জমি দান করেন,এই ভাবে ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় দিগম্বর ঘোষাল কোলসড়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দির।
         সেই থেকে আজও কোলসড়া গ্রামে সিদ্ধেশ্বরী কালী পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়ে আসছেন,বিশেষত্ব হলো এ ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় কালী পূজো গ্রামে হয় না এমন কি কালী সেজে কোন বহুরুপীকে গ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না,শুধু তাই নয় গ্রামের কোন বাড়িতে কালী ঠাকুরের কোন ক্যালেণ্ডারও রাখা হয় না।প্রতি বছর কার্তিক মাসে কালী পুজোর সময় ও চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে মহা ধূমধাম সহকারে গ্রাম বাসীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজার আয়োজন করে থাকেন,১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মন্দিরের পূজায় ঘোষাল পরিবারের সঙ্গে সমগ্র গ্রামবাসীর অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতায় সার্বজনীন পূজায় পরিণত হয়।
            পঞ্চমুণ্ডীর আসনে অধিষ্ঠত দেবীর মূর্তি তৈরী হয় সম্পূর্ণ গঙ্গার মাটির দ্বারা,প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য এই ঘোষাল পরিবারের ঈশ্বর চন্দ্র ঘোষাল প্রতিষ্ঠিত দূর্গাপীজাতেও ভোগ রান্না হয় সম্পূর্ণ গঙ্গা জলে।সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজায় বলি প্রথা প্রচলিত,এখানের পূজার আরো একটি ব্যতিক্রমী রীতি বিসর্জনের দিন পাঁচজন পুরোহিত দেবী মূর্তিকে খণ্ড খণ্ড করে ঝুড়িতে ভরে নিরঞ্জন করেন।এই ভাবে নিজস্ব বৈশিষ্ট ও ঐতিহাসিকতায় ঘোষাল পরিবারের সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মন্দির কোলসড়া গ্রামের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে,বাৎসরীক পূজার আনন্দে মেতে উঠে সারা গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ জন।


    দূর্গাপুরে ভবানী পাঠক পূজিত ভারত মাতাঃ

        প্রতি বছর শ্যামাপূজোর আগের দিন কৃষ্ণ পক্ষ ভূত চতুর্দশীতে দেবীর বাৎসরীক পূজোর আয়োজন করা হয়ে থাকে ধুম ধাম সহকারে,তবে দেবীর ভোগ পুরোপুরি নিরামিষ,যদিও পূর্বে দেবীর ভোগে মাছ দেওয়ার প্রচলন ছিল।মন্দির বেদীতে লিখিত আছে,' ঔঁ বন্দে মাতরম জয় জয় ভারত বর্ষম ',এ এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত, দেবী কালী এখানে ভারত মাতার কল্পনায় পূজিত,যা সমগ্র ভারত বর্ষে বিরল।শুধু তাই নয়, দেবীর মন্ত্রের সঙ্গে উচ্চারিত হয় " ঐক্যম শরণম গচ্ছামি,সত্যম শরণম গচ্ছামি,স্বরাজ শরণম গচ্ছামি। "

          তখনকার দিনের দেশপ্রেমী বিপ্লবীদের কাছে দুর্গাপুরের জঙ্গলের নিবিরে এ মন্দির ও আশ্রম হয়ে উঠেছিল গোপন আশ্রয় স্থান।ভবানী পাঠক - দেবী চৌধুরানী ও অনান্য বিপ্লবীদের পূজিত কালীমনন্দিরের কিছু দুরেই রয়েছে প্রস্তর নির্মিত এক প্রাচীন সুড়ঙ্গ, প্রচলিত আছে এই সুড়ঙ্গ পথটি নাকি ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণী ব্যবহার করতেন।রোমক স্থাপত্য রীতির প্রভাবে প্রভাবিত চুন বালি সুরকির মিশ্রণে বিভিন্ন আকৃতির বেলেপাথরের খিলানের এই সুড়ঙ্গ পথটি  সতের শতকে মুঘল শাষনের শেষের দিকে নির্মিত হয়েছিল গবেষকদের অনুমান।

     বর্ধমান জেলার তন্ত্রসাধনার ধারায় রয়েছে একাধিক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন, যেগুলি প্রাচীণত্ব ও বিশিষ্টতার দাবিরাখে।
**********************************
ফিরোজ আলি কাঞ্চন
শিক্ষক ও গলসির সাহিত্যকর্মি
বিঃদ্রঃ
প্রবন্ধটির কিছু অংশ আনন্দবাজার পত্রিকার বর্ধমান জেলার পৃষ্ঠায় উত্তর সম্পাদকীয় তে ২০১৯কালীপুজোর সময় প্রকাশিত হয়েছিল
এই সময় পত্রিকায় ভবানিপাঠাকের অংশ প্রকাশিত হয়েছিল।
ঐ দুটি প্রবন্ধর কিছু অংশ ও কিছু বাড়তি তথ্য যুক্ত করে এ প্রবন্ধ।
এ প্রবন্ধে,বা কোন অংশ অন্য কোন পত্রিকায় বা অন্যকোথাও প্রকাশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 
ছবি
তকীপুর গ্রামে বড় কালীর ছবি,তার মধ্যে একটি এক বছের প্রতিমা ভেঙে বিপর্যয় হয়েছিল,ক্রেন দিয়ে প্রতিমা তোলা হয়েছিল তার ছবি।

একটি দূর্গাপুরে ভবানীপাঠক পূজিত মন্দিরের ছবি







' বর্ধমান হচ্ছে কলকাতার মা '

           ফিরোজ আলি কাঞ্চন

শিরোনামের এই দাবি বিশিষ্ট  ভাষাচার্য ও বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃসুকুমার সেনের। কলকাতা নগর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় জেলা বর্ধমানের এক ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে,সে ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক যেন অনেকটা অভিভাবকের মতো।আর দেশ বা মাতৃভূমি আমাদের কাছে  মাতৃজ্ঞাণে পূজিত, তাই তিনি 'মা',এখানে অভিভাবিকা যেন।
          ব্রিটিস ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রশাসক জব চার্নক বাংলার নবাবের কাছথেকে১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে সুটানুটি অঞ্চলে কুটি স্থাপনের অনুমতি লাভ করেন।অবশ্য সুটানুটি,গোবিন্দপুর ও কলকাতা গ্রাম গুলির সত্বাধিকারী তখন ছিল সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের।কিন্তু ক্রমে ১৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে জব চার্নকের জামাতা চার্লস আয়ার মাত্র ১৩০০ টাকার মূল্যে সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর নিকট হতে গ্রাম তিনটির সত্ত্বাধিকারী ক্রয় করে নেন, এই সূত্র হিসেবে আমরা জেনে এসেছি জব চার্নক কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস এই ধারনা থেকে বেড়িয়ে এসেছে,কেননা একটা শহর বা নগর কোন ব্যক্তির একক উদ্যোগে কখনো গড়ে উঠতে পারে না।তাছাড়া আবুল ফজলের ' আইন-ই-আকবরি '(১৫৯০)গ্রন্থ সহ একাধিক গ্রন্থে  ' কলিকাতা ' নামটি পাওয়া যায়।এ প্রসজ্ঞে যেটা আরো গুরুত্ববহ, কলকাতা  হাইকোর্ট ২০০৩ সালে এক জনস্বার্থ মামলার রায়ের উল্লেখে জানিয়েছে কলকাতার প্রতিষ্ঠা কোন এক নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়।
           প্রকৃতপক্ষে কলকাতার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইতিহাসের এক ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়ায়,আর এই প্রক্রিয়ায় অভিবাবকত্বের ভূমিকায় ছিল জেলা বর্ধমান,আর সেই মর্যাদায় গৌরবান্বিত বোধকরে  ডঃ সেন বর্ধমান জেলাকে ' কলকাতার মা ' বলে অভিহিত করেছেন,আর এই উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের আরো অন্য এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
        বর্ধমানের মহারাজা তখন কৃষ্ণরাম রায়(১৬৭৫-১৬৯৬)।এই সময় বর্ধমান চাকলার বেশ কিছু অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে,যেমন -চেতুয়া ও বরদার জমিদার শোভাসিংহ,চন্দ্রকোনার তালুকদার রঘুনাথ সিংহ,উড়িষ্যার পাঠান রহিম খাঁন প্রমুখ গণ, এঁরা সকলে একত্রিত হয়ে বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম রায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রকোনার যুদ্ধে মহারাজা কৃষ্ণরাম রায়ের মৃত্যু হলে শোভা শিংহের নেতৃত্বে বিদ্রোহী দল মেদিনীপুর ও হুগলীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যা ও লুঠতরাজ চালিয়ে প্রবেশ করে বর্ধমান রাজমহলের অন্তঃপুরে,এই ঘটনা ছিল বর্ধমান রাজপরিবারের ইতিহাসে এক চরম অভিশাপ স্বরুপ।বিদ্রোহী দল রাজকোষাগার লুণ্ঠন করে,শুধু তাই নয় রাজ পরিবারের পঁচিশ জন সদস্য কে নির্বিচারব হত্যাকরে,সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হল মদ্যপ শোভাসিংহ মাতাল হয়ে কৃষ্ণরাম রায়ের কণ্যা রাজকুমারী সত্যবতীর কক্ষে প্রবেশ করে সত্যবতীকে সম্ভোগ করতে উদ্যত হয়,কিন্তু রাজকুমারী কেশপাশে লুকিয়ে রাখা তীক্ষ্ণধার ছুরি দিয়ে  লম্পট চরিত্রহীন শোভাসিংহের উদর বিদীর্ণ করে দেয়।
        শোভাসিংহের মৃত্যুর পর বিদ্রোহী দলের নেতৃত্বের লাগাম চলেযায় উড়িষ্যার বিদ্রোহী পাঠান রহিম খাঁর হাতে।সমগ্র বর্ধমান জেলাজুড়ে চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ ও লুঠতরাজ। এদিকে শরিফাবাদ বর্ধমানের এই চরম অরাজকতার সংবাদে বিচলিত হয়ে উঠেন দিল্লীর সম্রাট। ঔরঙ্গজেব স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে নিজের নাতি, অর্থাৎ বাহাদুর শাহর পুত্র আজিম-উস-সানকে সুবেদার নিয়োগ করে বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে বর্ধমানে প্রেরণ করেন।আজিম-উস-সানের সাথে পাঠানো হলো বিশ্বস্ত উজির খাজা সৈয়দ আনোয়ারকে।
         বর্ধমানের এই অরাজকতা সারা বাংলার ক্ষেত্রে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না,আর সে সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য অতি মাত্রায় সচেষ্ট হয়ে উঠে বণিকের ছদ্মবেশে আমাদের দেশে আগত বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিগুলি।এই প্রচেষ্টায় সহায়ক হয়ে উঠে কুচক্রী ও দূরদৃষ্টিহীন আজিম-উস-সান, অবশ্য তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দিল্লীর সিংহাসনের দখল,এ জন্য যেন তেন প্রকারেণ অর্থ সংগ্রহে তিনি ছিলেন খুবই আগ্রহী। অর্থের বিনিময়ে তিনি ওলন্দাজদের চিনমুখায় ফোর্ট গুস্টাভাস এবং চন্দন নগরে ফরাসিদের ফোর্ট অর্লিন্স গড়ে তোলার অনুমতিও দিয়েছিলেন।অন্যদিকে পূর্ববর্তী বাংলার সুবেদার ইব্রাহিম খাঁর নিকট হতে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী দুর্গ নির্মানের যে অনুমিত পেয়েছিল,সে অনুমতির ভিত্তিতে সুটানুটি,গোবিন্দপুর ও ডিহি কলকাতা গ্রাম তিনটি পুরোপুরি ক্রয় করার পরিকল্পনা গ্রহন করে।আজিম-উস-সান বর্ধমানে অবস্থান করেছেন দেখে কোম্পানির পক্ষথেকে প্রতিনিধি দল আবেদনের আর্জি নিয়ে উপস্থিত হন বর্ধমানে,কোম্পানীর পক্ষেথেকে এই কার্য সমাধান করার বিশেষ দায়ীত্বে ছিলেন ওয়ালস।কিন্তু বিচক্ষণ ও দূরদর্শী  উজির খাজা আনোয়ার এ প্রস্তাব সঙ্গেসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন,তিনি আজিম-উস-সানকে পরিস্কার জানিয়ে দেন এ প্রস্তাব সম্পাদিত হলে ভবিষ্যৎ হবে ঘোর মারাত্মক,ফলে প্রস্তাব নাকচ হয়েগেল।
         কিন্তু দুঃখের বিষয় দামোদর নদের দক্ষিণে ' মূলকাঠি 'নামক স্থানে রহিম খাঁর বিশ্বাস ঘাতকতায় খাজা আনোয়ারের মৃত্যু ঘটে।সন্দেহ জাগে এ বিশ্বাসঘাতকতা আবার আজিম-উস-সানের ছিল না তো! তিনি হয়তো ভেবেছলেন দিল্লীর সম্রাটের অনুগত এই উজির তার স্বপ্নের বাস্তবয়ানের পথে বর্ধমানের সফরে বাধা হয়ে উঠেছে?যদিও বর্ধমানের ঐতিহাসিকগণ তেমন কোন ইঙ্গিত দেননি,তবে ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে প্রাবন্ধিকের প্রশ্ন অমূলক নয়।যুদ্ধের মাঝে আজিম-উস-সান দূত মারফত রহিম খাঁর কাছে অনুরোধ পাঠালেন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলে ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে।রহিম খাঁ স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন।আজিম-উস-সান মাত্র কয়েকজন সৈন্য দিয়ে খাজা আনোয়ারকে পাঠালেন চুক্তি সম্পাদনের কাজে!খাজা আনোয়ার রহিম খাঁর শিবিরে উপস্থিত হয়েই টের পেলেন কেমন যেন সন্দেহের পরিবেশ,তিনি শিবিরে প্রবেশ না করে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলেন,কিন্তু অতর্কিত আক্রমণে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তিনি শহীদ হন (১৬৯৮)।এই দুঃখ জনক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ফারুক শিয়র খাজা আনোয়ার ও চারজন শহীদের মাজার সৌধ ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় দুই লক্ষ্য মূদ্রা ব্যয়ে নির্মাণ করেন,বর্ধমান শহরের বেড় এলাকায় অবস্থিত এই স্মৃতি সৌধের মকরেবায় রয়েছে তিন গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,বাঁধানো পুষ্করিণীর মাঝে হাওয়া মহল।সেদিন খাজা আনোয়ারের মৃত্যু না হলে ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইতিহাস হয়তোবা অন্যভাবে রচিত হত।
     আজিম-উস-সান বর্ধমানে অবস্থানকালে সঙ্গে এনেছিলেন দুই পুত্র করিম উদ্দিন ও ফারুক শিয়কে।খাজা আনোয়ারের মৃত্যু যেন কোম্পানীকে স্বস্তি এনে দিল।ফারুক শিয়রকে প্রভাবিত করে আবার তারা ঝুলে থাকা প্রস্তাব পুর্নবিবেচনার জন্য আবেদন জানালো।আর এই আবেদন প্রস্তাবের জন্যই যেন আজিম-উস-সান অপেক্ষায় ছিলেন,ষোল হাজার টাকার বিনিময়ে সুটানুটি,গোবিন্দপুর ও ডিহি কলকাতা গ্রাম তিনটি তিনি ইংরেজ কোম্পানীকে বিক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করলেন ১৬৯৮ সালে নভেম্বর মাসে।চুক্তি পত্রে দেওয়া হয়েছিল কাজির মোহর,ছিল জমিদার গণের স্বাক্ষর, বার্ষিক খাজনা নির্ধারণ হয়েছিল ১১৯৪ টাকা ১৪আনা ৫পাই।
         কোম্পানীর সঙ্গে আজিম-উস-সানের এই চুক্তি সম্পাদনের সই সাবুদ ঠিক কোন স্থানে হয়েছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে,কলকাতার ঐতিহাহিক গণের এ ক্ষেত্রে বর্ধমান জেলাকে মর্যাদাদিতে যেন কৌলিণ্য ক্ষুণ্ণ  হয়! কিন্তু বর্ধমানের ভূমিপুত্র  ডঃসুকুমার সেন বা বর্ধমানের ইতিহাস রচয়িতা যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী,সাহিত্য বিনোদ নীরদবরণ সরকার প্রমুখগণ এ ক্ষেত্রে বর্ধমানের মাটিকেই চিহ্নিত করেছেন।আর এ দাবিই যুক্তিযুক্ত,কেননা আজিম-উস-সানের বর্ধমানে অবস্থান মাত্র কিছু দিনের জন্য অস্থায়ী ছিল না,তিনি বেশ কিছুটা সময় বর্ধমানে অতিবাহিত করেছিলেন,সজ্ঞে পুত্রদেরও এনেছিলেন।বর্ধমান শহর পায়রাখানা গলিতে অবস্থিত জুম্মা মসজিদটি তনি ১৬৯৯খ্রিষ্টাব্দে ইবাদতের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন,কাজেই এও স্বাভাবিক।তিনি শাসন কার্য বর্ধমান থেকেই পরিচালনা করতেন,এবং চুক্তি রাঢ় বাংলার মধ্যমণি বর্ধমানেই সম্পাদিত হয়েছিল,সেই আব্দারের দাবিতে সম্পর্কতো থাকবেই।
------------------
।প্রবন্ধটি গলসি বিবেকানন্দ  ক্লাবের সারদীয় পুজো পত্রিকায় ২০১৯ প্রকাশিত
            ফিরোজ আলি কাঞ্চন

গলসির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

915
        
     
      
         


বর্ধমান জেলার প্রাচীন মসজিদ 
   ফিরোজ আলি কাঞ্চন


    বর্ধমান জেলার স্থাপত্য শিল্পের সাংস্কৃতিক নিদর্শনে যেমন প্রাচীন হিন্দু দেব মন্দির ও দেউল গুলির নান্দনিক সৌন্দর্য ঐতিহ্যমণ্ডিত,তেমনি আবার  বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন মসজিদ  গুলির গঠন শৈলীর বিশেষত্ব জেলার স্থাপত্যশিল্পের অধ্যায়কে করে তুলেছে আরও সমৃদ্ধ।মোঘল যুগে বর্ধমান জেলাকে বলা হতো ' সরিফাবাদ ',অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বসবাসের স্থান।আবুল ফজলের ' আইন-ই-আকবরী ' গ্রন্থে ষোড়শ শতকের শেষের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের সময় সমগ্র বাংলাকে ঊনিশটি সরকারে বিভক্ত করা হয়েছি,তার মধ্যে সরিফাবাদের অন্তর্ভুক্ত বর্ধমানের নাম উল্লেখিত।ভাগ্যান্বেষনে দিল্লীর  সুলতানদের জীবনের বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতে নিরাপদ আশ্রয়স্থান হয়ে উঠেছিল বর্ধমান।শাহজাহান থেকে শেরশাহ,নূর জাহান থেকে আজিম-উস-সান , ফারুকশির প্রভৃতি তৎকালীন রাজনীতির অনেক কেন্দ্রীয় চরিত্র দিল্লী থেকে বহু দূরে এ সরিফাবাদে এসে অবস্থান করেছিলেন।ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বর্ধমান জেলার বিভিন্ন স্থানে সেইসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপাসনাস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাধিক মসজিদ,মক্তব।আবার গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহ বা দিল্লীর সম্রাট গণ বর্ধমান জেলার বিভিন্ন পীর ওলি আওলিয়াগনের মাজারের নিকটে মসজিদ নির্মাণ ও পুকুর খনন করে দিয়েছিলেন।    
          অখণ্ড বর্ধমান জেলার প্রাচীন মসজিদ গুলি জেলার ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব সব নিদর্শন। শিল্পকলার বৈশিষ্টে মসজিদগুলিতে পারসিক শিল্পরীতির প্রভাব যেমন বিদ্যমাম তেমনি লক্ষনীয় ইসলামিক শিল্পরীতির  সঙ্গে গৌড়িয় শিল্পরীতির মিলন;এ ছাড়াও বেশকিছু প্রাচীন মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক কিছু চরিত্রের ঘটনা প্রসঙ্গ।বর্ধমান শহরে পুরাতনচকে,খক্কর সাহেবের মাজারের নিকট  ' কালো মসজিদ 'টি শেরশাহ ৯৫০ হিজ, ইংরাজি ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন, মসজিদে আজো রয়েছে শেরশাহের লিপি।হুমায়ুন শেরশাহের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে চুনার দুর্গ আক্রমণ করে সময়নষ্ট করতে থাকে,সেই সুযোগে শেরশাহ বর্ধমানে পালিয়ে এসে পরবর্তী পদক্ষেপের প্রস্তিতি নিতে থাকেন, পরে দিল্লীর ক্ষমতায়    অধিষ্ঠিত হয়ে এই মসজিদটি নির্মান করে দেন।সাহাচেতন পুরে পীরবাহারামের মাজার সৌধের সঙ্গে যুক্ত এক প্রাচীন মসজিদ।পীর বাহারাম ছিলেন সম্রাট আকবরের খুব শ্রদ্ধাভাজন, কিন্তু আবুল ফজলের তা অপছন্দ হলে পীর বিরক্ত হয়ে বর্ধমানে এসে যোগী জয়পালের আশ্রমে আশ্রয়   নিয়ে সাধনা করতে থাকেন,১৫৬৪খ্রিষ্টাব্দে এই সাধকের জীবনাবসান হলে আকবর পীর বাহারামের মাজার সৌধ নির্মাণ করেদেন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের  জন্য চারটি মৌজা দান করেছিলেন।আবার ঔরজ্ঞজেবের নাতি আজিম-উস-সান যখন  শোভা সিংহের দ্বারা মহারাজ কৃষ্ণরাম রায়ের হত্যার পর বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করার জন্য বর্ধমানে অবস্থান করেছিলেন তখন তিনি আলম গঞ্জে তিন গম্বুজ ওয়ালা মসজিদটি নির্মান করেন ১৬৯৯খ্রিষ্টাব্দে।
১৭ নম্বর ওয়ার্ডে নবাব বাড়ি বা খাজা আনোয়ার বেড়ের সমাধিক্ষেত্রের চত্বরে রয়েছে এক প্রাচীন মসজিদ।কৃষ্ণরাম রায়ের কণ্যা সত্যবতীর হাতে লম্পট শোভা সিংহের মৃত্যুর পর বিদ্রোহী দলের লাগাম চলেযায় পাঠান রহিম খাঁর হাতে,এই রহিম খাঁর বিশ্বাস ঘাতকতায় আজিম-উস-সানের উজির খাজা আনোয়ারের মর্মান্তিক মৃত্যুকে স্মরণ করে ফারুক শিয়র এই মসজিদ ও সামাধি সৌধস্থল নির্মান করেন।আবার ফারুক শিয়র তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু সুফি বায়াজিদের সম্মানে কালনা রোডে প্রতিষ্ঠা করেন বন-মসজিদ।
বর্ধমানে অবস্থানকালে আজিম-উস-শানের সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই পুত্র করিম উদ্দিন ও ফারুক শিয়র।একদিন তিনি দুই পুত্রকে পাঠালেন জীন্দাপীর হজরত বায়াজিদের কাছে দোয়া প্রার্থনার জন্য।প্রচলিত আছে পীরের সাধন কক্ষে আজিম-উস-সানের দুই পুত্রের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হজরত বায়াজিদ তাদের প্রতি সালাম জানিয়ে বললেন,'আসসালামু আলাইকুম ' অর্থাৎ  আপনার/আপনাদের উপর প্রভুর করুণা বর্ষিত হোক।কিন্তু তার প্রত্যুত্তরে করিম উদ্দিন দিলেন না,রাজকীয় গাম্ভীর্যে তিনি নীরব থাকলেন;তবে ফারুকশিয়র ' ওয়া আলাইকুম আসসালাম ' অর্থাৎ আপনার উপরেও প্রভুর করুণা বর্ষিত হোক ' বলে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আদব কায়দার সাথে পীরকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদান করলেন।সুফি বায়াজিদ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন 'হিন্দুস্থানের ভাবি সম্রাট বসুন ',কিন্তু এবারেও করিমউদ্দিন গাম্ভীর্যের সাথে দাঁড়িয়ে থাকলেন,কন্তু ফারুক শিয়র আসন গ্রহন করলেন,আর এখানেই যেন তিনি পীরের আশির্বাদ পেয়েগেলেন,ইতিহাস সাক্ষী১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনিই বসেছিলেন সিংহাসনে।সম্রাট হয়েও ফারুক শিয়র ভুলে যাননি তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু সুফি বায়াজিদের কথা,তিনি অস্তানায় একটি মসজিদ তৈরী করেদেন।বর্ধমান কালনা রোডের ধারে অবস্থিত এই মসজিদটি বর্তমানে বন মসজিদ নামে পরিচিত

    বর্ধমানের মূল শহরে অবস্থিত আরো অসংখ্য প্রাচীন মসজিদ গুলির মধ্যে অন্যতম ইছলাবাদে ১১১৫ হিজরি, ইংরাজি১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত তিন গম্বুজ ওয়ালা মসজিদ,বি.সি.রোডে পায়রাখানা গলিতে অবস্থিত প্রাচীন 'নূর মসজিদ ',কাটরা পোতার প্রাচীন তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ,তেঁতুল তলা বাজারে প্রাচীন ' মদিনা মসজিদ ',রাধানগর পাড়ায় ' মক্কা মসজিদ ',গোদা অঞ্চলে ' সান মসজিদ ' ও একটি এক গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,পুরাতন চকে 'কালো খা মসজিদ',এছাড়াও শহরের ছোট নীলপুর ,তেজ গঞ্জ,কমল সায়ের,মির ছবা,গোলাপ বাগের হাজিপোতা,কেশবগঞ্জ চটি প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাচীন মসজিদ রয়েছে।
     অজয় নদের তীরে প্রাচীন জনপদ মঙ্গল কোটে  পীর হামিদ বাঙালীর মাজারের নিকট অবস্থিত বারো দরওয়াজা মসজিদটিও বিখ্যাত।সিংহাসন লাভের পূর্বে শাহজাহান পিতার সঙ্গে মনোমালিন্য  করে মঙ্গলকোটে এসে আত্মগোপন করে ছিলেন,এখানে আধ্যাত্মিক সুফি সাধক মৌলানা হামিদ দানেশমন্দের সান্নিধ্য তিনি লাভ করেন,এই সাধক বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজেকে 'বাঙালী ' পরিচয় দিতেন।পরে সম্রাট হয়ে শাজাহান ৯৪হাজার স্বর্ণ মূদ্রা ব্যয়ে  মসজিদটি ১৬৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণকরে দেন। মঙ্গল কোটের দাঁই হাটে  মাটির স্তুপের উপর প্রস্তর খণ্ডে নির্মিত ফুল,লতা পাতার নক্সাযুক্ত ভগ্ন মসজিদটি হুসেন শাহ নির্মিত,এ ছাড়াও রয়েছে ১৭১৭খ্রিষ্টাব্দে শাহ আলম খান প্রতিষ্ঠিত ছয় গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,বাদশাহি সড়কের ধারে  বায়খা ও কুলটি গ্রামের প্রাচীন মসজিদ দুটি হুসেন শাহের আমলে নির্মিত।
  কালনা অঞ্চলে টেরাকোটা ভাস্কর্যযুক্ত মসজিদ-ই-জামিয়া ১৫৩৩  খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন ফিরোজ শার কালে উলুঘ মুসুয়ানী খান নির্মান করেনদাঁতন কাঠি তলা নামক স্থানে।এ ছাড়াও এখানে রয়েছে ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আবুল মুজাফফর বাহাদুর শাহের নির্মিত মসজিদ,বদর সাহেবের মসজিদ,১৪৯০খ্রিষ্টাব্দে মামুদ শাহের রাজত্বকালে মজলিস সাহেবের মসজিদ, শাসপুর-দিঘীর পাড়ে আছে হাবসি রাজাদের আমালের প্রাচীন মসজিদ, পূর্বস্থলীর জাহাননগরের জাহান আলি খানের সময়ের প্রাচীন মসজিদ ইত্যাদি।
   কাটোয়ার বাগান পাড়ায় চার মিনার ও ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট প্রাচীন মসজিদটি শাহ আলমের আমলে নির্মিত,ভাতার থানা অঞ্চলের কালুত্তক গ্রামে হজরত কালুত্তক সাহেবের মাজারের নিকট প্রাচীন মসজিদটি হুসেন শাহ প্রতিষ্ঠা করেন।আউসগ্রামের সুয়াতায় পীর বাহমান সাহেবের মাজারের নিকট হুসেন শাহ একটি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়ে ছিলেন, যদিও বর্তমানে তা নিশ্চিহ্ন।সাহিত্য বিনোদ আয়ুব হোসেন আবিস্কৃত 'মৃগাবতী' কাব্যের পুঁথির লেখক আব্দুল আলিম ছিলেন সুয়াতার এই পীরের মাজারের খাদেম বা সেবক,তাঁর সময়সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ হজরত শাহ মাহামুদ বাহামানীর মাজারে কবর জিয়ারত করতে আসেন;তখন তিনি সুলতানকে শুনিয়েছিলেন মৃগাবতী কাহিনীর রুপকথা।মুগ্ধ হয়ে সুলতান খাদেম আব্দুল আলিমকে কাব্য রচনার আদেশ দেন,এবং পীরের মাজার বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন ও একটি মসজিদ নির্মান করে দিয়েছিলেন,'রাজ বন্দনা ' অংশে কবি লিখেছেন-"মহামতি হুসেন শাহ বড়া সুলতান/পঞ্চগৌড় জিনিয়া গৌড়ের প্রধান।/...সুয়াতা গাঁয়েতে আছে পীর বাহামান,/মাজার বাঁধাল রাজা জমি দিল দান।/মাজারের উত্তরে ভালকী নগর/মসজিদ রচিল সেথা অতি মনোহর।

   কেতুগ্রামের নরসিংহপুর ও কুলুট গ্রামে রয়েছে প্রাচীন মসজিদ,বেলওয়ারী গ্রামের মসজিদে চুন বালির আস্তরনে অলংকরণ খুবই সুন্দর।মালডাঙ্গার  বোহার গ্রামেও প্রাচীন মসজিদ দেখাযায়,কুলুইতি গ্রামের  মাটির খিলানের প্রাচীন মসজিদটি  উনিশ শতকের।ভাতার অঞ্চলের এরুয়া গ্রামে রয়েছে পাঁচটি প্রাচীন মসজিদ।পূর্বস্থলির মেড়তলা গ্রামে তালপাতা  পাড়ায় আছে এক প্রাচীন মসজিদ,  আউস গ্রামের  সর গ্রামের পাঠান পাড়ায় এক গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,দিগনগর গ্রামে ভগ্ন প্রায় পাঁচশত বছরের প্রাচীন মসজিদ,বুদবুদের মারো কোটা গ্রামে প্রাচীন মজ্জিদের ধ্বংসাবাশেষ ও তার নিকটেই এক গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ,গলসি অঞ্চলের আদড়াহাটি,জাগুলপাড়া,মসিদপুর,সরমারো-কোটাগ্রামের প্রাচীন মসজিদ ও ভুড়ি গ্রামের প্রাচীন মসজিদের ভগ্নাবশেষ জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসে বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
    সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালীর ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন,সেই আক্ষেপ যেন আজো আমাদের রয়েগেল।জেলার ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন মসজিদ গুলির বেশিরভাগই বর্তমানে ধ্বংসপ্রায় বা সংস্কারের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে,শুধু মসজিদ নয়,জেলার অনেক প্রাচীন মন্দির,দেউল, বা কবি লেখক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী দের স্মৃতি বিজরিত স্থানগুলি আজ অবহেলা ও উদাসীনতায় প্রচারের অন্তরালে থেকে যেন শেষ অস্তিত্বটুকু নিয়ে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার অপেক্ষায়।অথচ এগুলির ঐতিহ্যের সঠিক অনুসন্ধান ছাড়া বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসের পরিপূর্ণতা অসম্ভব।
----------------------_----
লেখক শিক্ষক,গলসি আঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মি
ছবিঃ
নতুনহাটে হুসেনশাহী মসজিদের ধ্বংসাবশেষ ২টিছবি

গোলাপবাগে হাজিপোতা মসজিদ

গলসি জাগুলিপাড়া গ্রামের প্রাচীন মসজিদ

বাহির সর্বমঙ্গলাপাড়ার জামা মসজিদ



  ৷৷ ৷৷৷৷  মঙ্গোল কোটে হুসেন শাহী মসজিদ।।।
৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷  বর্ধমান গোলাপবাগে হাজিপোতা মসজিদ।।।।