বর্ধমান জেলায় মহরম
শোকের আবহে শান্তির বার্তায় মহরম
ফিরোজ আলী কাঞ্চন
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মূলত কোন বিভাগ না থাকলেও হজরত মহম্মদের(সাঃ)পরলোক গমনের পর ইসলাম ধর্ম সুন্নী ও শিয়া এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।সুন্নীর অর্থ সুন্নতের অধিকারী,যাঁরা নবিজীর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে তাঁরাই সুন্নী।বাংলার তথা ভারত বা পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ মুসলমানই সুন্নী মতাবলম্বী।আর শিয়া শব্দের অর্থ দল।হজরত মহম্মদের(সাঃ) ইন্তেকালের পর খলিফা কে হবেন এই নিয়ে বিতর্ক দেখাযায়,নবিজীর জামাতা হজরত আলিকে খলিফা হিসেবে সমর্থন করে শিয়া দলের উৎপত্তি।ইরাক,ইরান শিয়া অধ্যুষিত দেশ,ভারতের মুসলিমরা সুন্নি প্রাধান্য হলেও কিছু সংখ্যক শিয়া মতাবাদী মুসলিমও রয়েছে,হায়দ্রাবাদের সুলতান টিপুর বংশ,জিন্নাহ,বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা প্রমুখগণ শিয়া ছিলেন।
শিয়া ও সুন্নী উভয় মতাবলম্বী গণের কাছেই মহরমের গুরুত্ব অপরিসীম।পবিত্র কোরান অনুসারে আরবি বারোটি মাসের মধ্যে যে চারটি মাস আল্লাহ তলার কাছে সবচেয়ে সম্মানিত তার মধ্যে অন্যতম মহরম মাস।'মহরম ' প্রকৃতপক্ষে একটি মাসের নাম,তবে শিয়া ও সুন্নীদের কাছে এমাসের গুরত্ব আলাদা আলাদা।সুন্নীরা এ মাসে রোজা রাখে,দান-খয়রাত করে থাকে,অপরদিকে শিয়ারা রোজা রাখা বা দান খয়রাতের সাথে সাথে মহরমে তাজিয়া,লাঠিখেলা,মর্সিয়া গাওয়া ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেথাকে,যা সুন্নীরা পছন্দ করেন না।স্বাভাবিক ভাবে সচেতন পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেপারে আমাদের এখানের মুসলিমরা সুন্নী হয়েও মহরমে তাজিয়া বেরকরে, মর্ছিয়া গায় বা লাঠিখেলে কেন?আসলে এখানেই লুকায়িত আছে বাংলার সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাটি,যা সকলকে আপন করে নেওয়ার।বাঙলায় ইসলামের আগমন ঘটেছে মূলত ইরান পারস্য হতে আগত পীর ওলী আউলিয়াদের মাধ্যমে,আর এই পীর আউলিয়ারা বাংলায় এসে এখানের সংস্কৃতির সজ্ঞে যেন মিশে গিয়েছিলেন।এ প্রসঙ্গে বলতে হয় মঙ্গলকোটের পীর হামিদ বাঙালীর কথা,সম্রাট শাহজাহানের আধ্যাত্মীক এই গুরু সুদূর পারস্য থেকে এসে মঙ্গলকোটে আস্তানা গড়েছিলেন।প্রকৃত নাম ছিল হামিদ দানেশাখন্দ,কিন্তু তিনি ক্রমে বাংলাকে ভালোবেসে,বাংলার মাটি জল হাওয়ার সাথে গভীর একাত্মতাবোধে নিজেকে ' বাঙালী ' পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন।তাইতো এইসব মহান ওলী আউলিয়াদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম এদেশে এসে হয়েউঠেছিল অনেক উদার।এখানের মুসলিমরা একদিকে যেমন শিয়া ও সুন্নীর সমন্বয় সাধন ঘটিয়েছে,তেমনি আবার বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যের ধারাকেও বজায়রেখেছে।আর নবিজীর আদর্শ ছিল এটাই,তিনি আরবের পূর্ব বর্তী সমস্ত জনজাতিকে নিয়ে এক অখণ্ড মানবতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, হজরত মহম্মদ (সাঃ) আমাদের দেশে আসতে পারেননি কিন্তু আরব,ইরান,পারস্যথেকে এই পীর আউলিয়াগণ সেই মানবতার বাণীই এখানে এনে যেন পৌছে দিলেন,সেই সূত্র ধরেই সুন্নী প্রধান এদেশেও মহরম মানে রোজা,দান ধ্যানের পাশাপাশি ' হায় -হোসেন, হায় -হোসেন 'প্রলাপে বুকফাটা ক্রন্দন।
'মহরম ' আরবি শব্দ,এর অর্থ পবিত্র বা সম্মানিত।ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাসের নাম মহরম।বিশ্বাস অনুযায়ী এ মাসে পরম প্রভু আল্লাহতালা এই বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন,এই মাসে আদি পিতা হজরত আদম কে সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই মাসেই স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে পৃথিবীতে পতিত হয়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আদিপিতা আদম ও মা হাওয়া পরস্পরকে দেখাপেয়েছিলেন;এছাড়া আরো একাধিক ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ৬১হিজরী ১০ই মহরম- আশুরার দিন কারবালার প্রান্তরে এজিদ বাহিনীর হাতে ইমাম হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যুর কাহিনী;এই বিষাদ গাঁথাকে স্মরণ করে মুসলিম সমাজ পরম ভক্তিভরে পালন করে থাকে শোকের পরব মহরম।
মহরমের দিন রোজা রাখা হয়,গরিব মিসকিনদের বিতরন করা হয় চালের আটার পিঠে,হালুয়া সুজি,কোথাও পথিকদের জল পান করানো হয়,কোথাও বেরকরা হয় তাজিয়া,লাঠি খেলা হয়,মর্সিয়া গাওয়া হয়।হাসান,হোসেনের করুণ গাঁথাকে গাইতে থাকে মূল গায়ক আর বাকীরা বুক চাপড়ে বলতে থাকে ' হায় হোসেন,হায় হায়!!'।অনেকে আবার হাতের আঙুলের মাঝে রাখে ব্লেট আবার অনেকে পিঠি মারতে থাকে খঞ্জর।
কারবালার এই হৃদয়বিদারক কাহিনি অবলম্বনে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ' মহরম' কবিতা-"মহরম ! কারবালা ! কাঁদো হায় হোসেনা ! / দেখো মরু - সূর্য এ খুন যেন শোষে না।"কবিতাটি ' মোসলেম ভারত ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।মহরমের মর্সিয়ার করুন সুর যেন হৃদয় কে স্পর্শ করে।'মর্সিয়া' আরবি শব্দ,যার অর্থ শোক পেকাশ।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অনেক কবি ফারসি ও উর্দু মর্সিয়ার ভাবধারা অবলম্বনে বাংলা মর্সিয়া রচনা করে নিজস্ব স্বতন্ত্রতার পরিচয় দিয়েছেন,এঁদের মধ্যে হামিদুল্লাহ,মোহম্মদ খান,শাহ গরীবুল্লাহ,হিন্দু কবি রাধামোহন গোপ,মীর মোশাররফ হোসেন,হামিদ আলী,কায়কোবাদ,শেখ ফয়জুল্লা প্রমুখগণ উল্লেখ্যোগ্য।
পূর্বেই বলা হয়েছে মুসলিম সমাজের আবার একটা অংশ এই লাঠি খেলা,তাজিয়া বেরকরা,মর্সিয়া গাওয়া বা খঞ্জর চালানোর বিরোধী,আর এক পক্ষ্য বলে মর্সিয়া গেয়ে,লাঠি খেলে,ধারালো খঞ্জরের আঘাতে রক্ত ঝরিয়ে যেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার সজ্ঞে নিজেদের একাত্মতা অনুভূত হয়েথাকে।ধু ধু মরু প্রান্তরে হোসেন পুত্র আলী আসগর একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করতে থাকে,পিতার কাছে কচি সেই প্রাণ আধো আধো স্বরে বলতে থাকে ' আল-আৎশ!', ' আল-আৎশ!! ' অর্থাৎ পিপাসা,পিপাসা।চারিদিকে শত্রু সৈন্যে আবদ্ধ হোসেন নিজের জিহ্বা পুত্রের মুখে পুরে দিলেন,কিন্তু তাতে কি আর গলা ভিজে?দুধের শিশুকে কোলে তুলে হোসেন বাইরে বেড়িয়ে শত্রু সৈন্যদের কাছে শুধু পুত্রের জন্য একটু জলের প্রার্থনা জানালেন,বিনিময়ে ছুটে এলো তীর,বিদ্ধ আসগর কে ফিরিয়ে নিয়ে এসে হোসেন স্ত্রীর কোলে তুলে দিয়ে বললেন,'এই নাও তোমার পুত্র,ওর সারা জীবনের মতো তৃষ্টা মিটে গেছে,ও আর কোনদিন পিপাসা পিপাসা বলবে না।'এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া সাখাওত হোসেন লিখেছেন," এই যে মহরমের নিশান,তাজিয়া প্রভৃতি দেখা যায়,ঢাক ঢোল বাজে,লোকে ছুটাছুটি করে,ইহাই কি মহরম?...আচ্ছা তাহাই হউক;ঐ নিশান তাজিয়া লইয়া খেলাই হউক; কিন্তু ঐ দৃশ্য কি একটা পুরাতন শোক স্মৃতি জাগাইয়া দেয় না?বায়ু হিল্লোলে নিশানের কাপড় আন্দোলিত হইলে তাহাতে কি স্পষ্ট লেখা দেখা যায় না- 'পিপাসা '? "
বর্ধমান জেলার আসানসোল, বার্ণপুর,রাণীগঞ্জ,জামালপুর,কা লনা,কাটোয়া,গলসির খেতুড়া,দয়ালপুর,দরবাপুর,বাহি রঘন্না সহ বিভিন্ন অঞ্চলে মহরমের তাজিয়া বের হয়ে থাকে,মূল বর্ধমান শহরে বি সি রোডে এক বিশাল শোক মিছিল বেড় হয়,কালাপাড়ি পীরের আস্তানা থেকে ঢাল বের হয়ে পুরো শহর পরিক্রমা করে। এ ছাড়াও পুরাতন চক, দুবরাজ দিঘী,ছোট নীল পুর,কুরমুন চন্দনপুর, খাজা আনোয়ার বেড় এলাকা থেকেও ঢাল বের হয়ে থাকে।কয়েক বছর আগে দূর্গাপুজো ও মহরম একই সময়ে পড়েছিল,গলসির চৌমাথার স্টার ক্লাবের পুজোমণ্ডপে খেতুড়া,বাহিরঘন্না গ্রামের ছেলেরা মহরমের মর্সিয়া গেয়ে এক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।আবার সে বছর পুজো ও মহরম এক সঙ্গে হওয়ায় ঢাক ঢোল বাজনা নিজেদের মধ্যে ভাগকরে নিয়েছিলেন ভাতারের এরুয়ার কাজীপাড়ার মহরম কমিটি ও স্থানীয় পুজো কমিটির সদস্যগণ।আউস গ্রাম অঞ্চলের সিলুট বসন্তপুর গ্রামে মহরমে নাটক,যাত্রা,কবিতা আবৃতি,গজল,কেরাতপাঠের আয়োজন করা হয়ে থাকে।কয়রাপুর গ্রামে মহরমে বিশেষ কিছু রীতি পালন করা হয়,গ্রামের বাছায় দশ জন ব্যক্তি ব্রত পালন করে থাকে,মহরমের চাঁদ উঠার এক দিন পর এই দশজনে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে মজ্ঞল কোটে গিয়ে সেখানে আধ্যাত্মিক গুরু ছোট হুজুরের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে এসে মজ্ঞলকোটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পীর আউলিয়ার মাজার পরিক্রমা করে আবার অন্যপথে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরে এসে অবস্থান করে ইমামতলায়,এই ইমাম তলা হলো হাসান হোসেনের কল্পিত মাজার,এই কয়েকদিন ১০ই মহরম পর্যন্ত এই পালনকারীদের বাড়ির সজ্ঞে কোন সম্পর্ক থাকে না,এরা রোজারেখে থাকে,চুল, দাড়ি,নখ কাটা এই সময় গুলিতে নিষিদ্ধ;মহরমের দিন জ্বলন্ত আজ্ঞারের উপর দিয়ে হেটে আগুন মাতম করা হয়ে থাকে।অনেক মুসলিম প্রধান গ্রামে আছে ইমামতলা,মহরম শেষে তাজিয়া এনে ইমাম তলায় রাখাহয়।
বর্ধমান জেলার আসানসোল, বার্ণপুর,রাণীগঞ্জ,জামালপুর,কা
এভাবে শোকের আবহে ধর্মীয় আধ্যাত্মীকতার সাথে সাথে শান্তির দৃষ্টান্ত রেখেছে মহরম।
-
-
লেখক গলসির শিক্ষক,সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মি
ছবি
গলসির খেতুরা গ্রামে মহরমের ইমামতলা