চাঁদ সদাগরের চম্পক নগর
ফিরোজ আলী কাঞ্চন
" চম্পক নগরে বৈসে ছাঁদ সদাগর
মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর "
কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ
মঙ্গলকাব্য ধারায় মনসা মঙ্গল কাব্যের কাহিনীতে চাঁদ সদাগর,বেহুলা-লখিন্দরের পালা বাঙালী জাতির কাছে আজো জনপ্রিয়।তাইতো চলচিত্রে,যাত্রাপালায় বা বিভিন্ন গল্প,কাব্য,কবিতা কাহিনীতে বার বার এসেছে বেহুলা,গাঙুর নদী বা চাঁদ-চম্পা,সপ্ত ডিঙা মধুকরের প্রসঙ্গ।বাঙালী বণিক চাঁদ সদাগরের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও তীব্র জেদ,স্বামী হারিয়ে বেহুলার অকুল পথে ভেষে যাওয়া এবং চ্যাঙ বুড়ি কানির কুটিল ষড়যন্ত্র সব কিছুর মধ্যে বাঙালী যেন চেতনার খোরাক পেয়েছিল,হৃদয়ের একাত্মতা অনুভব করেছিল।
বর্ধমান থেকে গলসি হয়ে জাতীয় সড়ক ধরে পানাগড়ের আগে বুদবুদ বাইপাস থেকে দক্ষিণ দিকে কয়েক কিলোমিটার গিয়েই কসবা,প্রাচীন নগরী চম্পক।মনসামজ্ঞল কাহিনীর চাঁদ সদাগর ও বেহুলা সম্পর্কীত লোকবিশ্বাস আর জনশ্রতিতে এ স্থান খুবই আকর্শনীয় ও বিখ্যাত।
প্রচলিত আছে চ্যাঙবুড়ি কানি মনসা দ্বারা চাঁদের বাণিজ্যতরী সপ্ত ডিঙা মধুকর ডুবে যাওয়ার পর চাঁদ সদাগর এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন।এখানে আছে এক শিব মন্দির,জনশ্রুতি পরম শিবভক্ত চাঁদ সদাগর এই রামেশ্বর মন্দিরের প্রায় ৪০ইঞ্চি পরিধির কষ্ঠিপাথরের বিশাল শিব লিজ্ঞটি স্বয়ং স্থাপন করেছিলেন এবং প্রতিনিয়ত পূজা দিতেন।চাঁদ সদাগরের এই শিব ভক্তির পরিণামের কথা আমাদের জানা।গবেষক দের মতে বেনারস -কাশীর তিলভাণ্ডেশ্বর শিব লিজ্ঞের থেকেও এই অষ্টমুখি লিজ্ঞটি আকারে বড়ো।কাছেই খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত প্রাজ্ঞনে রয়েছে কিছুটা ভাঙা আর একটি অপেক্ষাকৃত ছোট শিব লিজ্ঞ,নাম বাণেশ্বর শিব।লোক বিশ্বাস রামেশ্বর আর বাণেশ্বর দুই ভাই।এই বাণেশ্বর শিব লজ্ঞটি কালাপাহাড় দ্বারা ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
মন্দিরের নিকট আছে এক প্রাচীন বট গাছ,যার মূল কাণ্ড বিলুপ্ত।বিশাল এই বটবৃক্ষ মন্দির ছত্তর অংশকে যেন এক নৈসর্গিকী সৌন্দর্য দান করেছে। মন্দির সংলগ্ন বিস্তৃত এলাকা ছিল ছাঁদ সদাগরের বসত ভিটে,এখানেই নাকি লখিন্দরের জন্ম।শিব মন্দির থেকে পূর্ব দিকে কিছুটা দূরে রয়েছে এক উঁচু ঢিপি,প্রচলিত এটাই নাকি ' সাঁতালি পর্বত ',এখানেই নির্মিত হয়েছিল বেহুলার লোহার বাসর ঘর।কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হয়নি, ক্ষুদ্র ছিদ্র পথে প্রবেশ করে মনসার আদেশে লখিন্দরকে দংশন করেছিল কাল নাগিনী।
বেহুলা মৃতস্বামীর দেহ ভে
লায় নিয়ে গাঙুরের জলে ভেসে পৌঁছেছিল ইন্দ্রের সভায়,সেই বিখ্যাত গাঙুর নদীও কসবা সংলগ্ন গলসীর মিঠাপুর,আতুসি গ্রামের উপর দিয়ে আজও তার ক্ষীণাকৃতি আকার নিয়ে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণটুকু টিকিয়ে রেখেছে।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মনসা মজ্ঞল কাব্যধারার পশ্চিম বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ তাঁর কাব্যে বেহুলার যাত্রাপথের যে বর্ণনা দিয়েছেন সেখানে যে স্থানগুলির নাম পাওয়া যায় সেগুলি এই বর্ধমান জেলার মধ্যেই অবস্থিত,যেমন গলসীর জুজুটি ঘাট,শিল্লা ঘাট,গোবিন্দপুর, মণ্ডল গ্রাম ইত্যাদি।
ছাঁদ সদাগর ও বেহুলার চম্পক নগর দেশের যে কোন স্থানে অবস্থিত তা নিদৃষ্ট করে বলা সম্ভব নয়,এ বিষয়ে কোন বির্তকে না গিয়ে বা এ সব ঘটনা কতদূর সত্য সে প্রশ্ন দূরে সড়িয়ে রেখে লোকবিশ্বাসে গলসির বুদবুদ অঞ্চলেরএই কসবা ভক্তি ও শ্রদ্ধার স্থান রুপে পরিগণিত। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে মনসা পূজা উপলক্ষে এখানে এক মেলা বসে।এছাড়াও সারা বছর ধরে বিভিন্ন জেলা থেকে এমনকি বাইরের রাজ্য থেকেও অনেকে এ স্থান পরিদর্শনে আসেন।শান্ত পরিবেশে এই স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই মনোরোম।স্থানীয় বাসিন্দা চয়ণ রায়গুপ্ত জানালেন," ঠিক মতো প্রচার পেলে স্থানটি পর্যটন কেন্দ্ররুপে গড়ে উঠতে পারে।"
------------/---/----/--//-///
No comments:
Post a Comment