বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঁথা শিল্প
ফিরোজ আলী কাঞ্চন
বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঁথা শিল্পের কাজ শিখতে কিছু দিন আগে আষ্ট্রেলিয়ার সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা লিজা উইলিয়াম ও কুড়ি জন পড়ুয়ার একটি দল এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলেন বর্ধমান শহরের কালীবাজারে আয়োজিত এক বুটিক কর্মশালায়(৮/২,জেলার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত)।এ থেকে প্রমাণিত কাঁথা শিল্প আজ শুধু বাংলা বা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই,বিদেশেও এর নান্দনিক সৌন্দর্য ক্রমশ বিকশিত।
" সোনা মা আমার! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন খাও মাথা,/ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা।/একটু আমারে ধর দেখি মাগো,সূচ সুতা দাও হাতে,/শেষ ছবিখানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে।"-- কাঁথার কথা বললেই মনে পড়ে যায় প ল্লী কবি জসীম উদ্দিনের 'নকসী কাঁথার মাঠ ' কাব্য কবিতার কথা।বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব লোকশিল্প এই কাঁথা শিল্প,বজ্ঞ নারী এই কাথার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেন বাংলার শিল্প,সংস্কৃতি, সমাজ ও সভ্যতার নানা রুপ ; লোক সংস্কৃতির এক উল্লেখ যোগ্য নিদর্শন হলো এই কাঁথা।
অল্প শিতে গায়ে দেওয়ার জন্য বা বচ্ছাদের শোয়ানোর কাজে বিছানোর জন্য এই কাঁথার ব্যবহার।এছাড়াও মেঝেতে বিছিয়ে খাওয়ার কাজে দস্তরখানা রুপে বা খাবার রাখার পাত্রের ঢাকনা হিসেবেও পাতলা কাপড়ের উপর সুতোর সূক্ষ্ম কারুকর্ম ফুটিয়ে তুলে কাঁথার ব্যবহার করা হয়।মূলত গ্রামবাংলার সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন বিত্ত মহিলাদের সাংসারিক এক উপকরণ হিসেবে এর উৎপত্তি,পুরানো কাপড়কে পরিস্কার করে কেচে তার উপর মেয়েলি হাতে ফুল,লতাপাতা,চাঁদ,তারা,বিভিন্ন পশু পাখির নকশা সূচ সুতোর মাধ্যমে রঙ বেরঙে ফুটিয়ে তুলে আবার নতুন করে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠে এই কাঁথা,এখন অবশ্য কাঁথা হচ্ছে নতুন কাপড় সুতোতে। এই কাঁথা আবার পবিত্র কোরান শরীফের ঢাকনা,নামাজ পড়ার জায়নামাজ বা পুজার আসন রুপেও ব্যবহার করা হয়।
কাঁথার বিভিন্ন নাম- সুজনি কাঁথা,নকশী কাঁথা,লোহিরা কাঁথা ইত্যাদি।সুজনি কাথায় থাকে স রু সুতোর সূক্ষ্ম কাজ,এই কাঁথা প্রচুর সময় ও শ্রম সাপেক্ষ।বাংলার মহিলা মহল পাড়া ঘরে অলস দুপুরে মা-ঝি জা-ননদের দল মিলে কেচ্ছা গাইতে গাইতে আপন খেয়ালে মনের মাধুরী মিশিয়ে দিনের পর দিন ধাপে ধাপে এই কাঁথা বুনে যেতেন।আর নকশী কাঁথায় থাকে নকশার বাহার,একাধিক শাড়িকে স্তরে স্তরে সাজিয়ে তার উপর বিভিন্ন নান্দনিক নকশা মেয়েলি হাতের বুননে এ কাঁথায় ফুটে উঠে।কাঁথার বুননে যেন প্রকাশ পায় মহিলা মহলের সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না,ব্যাথা-বে
মেয়ে জামায়ের বাড়িতে পাঠানোর জন্য
মায়েরা বিয়ের কয়েক বছর আগে থেকেই একটা একটা করে কাঁথা বুনে রাখতেন, ছোট বেলায় দেখেছি মা মাসি পিসির কাকীরা মেঝেতে পা মেলে বসে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে সুতো গতিয়ে পুরানো কাপড়ের পাড় থেকে রঙিন সুতো ছাড়িয়ে হাতের আঙুলের বিভন্ন কায়দায় গুটিয়ে সে সুতো সংগ্রহ করতেন।এখন আর সে সবের চল নেই।তবে আশার কথা
আধুনিকতার স্রোতে বাংলার অনেক লোকশিল্পের অস্তিত্ব বর্তমানে বিপন্ন হলেও,এই ঐতিহ্যময় সূচিশিল্প কিন্তু আজো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।নিজস্ব ঐতিহ্যে বাংলার এই লোকশিল্প জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ' প্রচেষ্টা ' নামে একটি সংগঠন বিভিন্ন স্কুলছুট ছাত্রী,বিধবা,বিবাহ বিচ্ছিন্না,সাধারণ গৃহবধূ ও মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে মহান ব্রত পালন করে চলেছেন।কাটোয়ার আলমপুরের অর্জুনডিহি গ্রামে ' আয়েসা ' নামে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা কাঁথাবুনে স্বয়ম্ভর হচ্ছেন।গলসি ব্লকের খেতুড়া গ্রামের সংখ্যালঘু মহিলাগোষ্ঠী গুলিকে সরকারী ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ,গলসি মহিলা সমাবায় সমিতির 'আনন্দধারা' গোষ্ঠীর সদস্য রা প্রশিক্ষন পেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন মেলায় স্টলের ব্যবস্থা করে নিজেদের হাতের কাজ জন সম্মুখে তুলে ধরছেন।
'কঙ্কন' স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য শাহনারা সেখ জানালেন,' সরকারী ভাবে শুধু প্রশিক্ষণ নয়,আমাদেরএক লাখ,একটু পুরানো হলে তিনলাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে।'রাজিয়া খাতুন জানালেন, "ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা থেকে সংসারের টুক টাক খরচ আমরা নিজেরাই চালিয়ে নিচ্ছি।'
স্থানীয় বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী মেলায় এঁদের স্টল বসে।কাঁথা এখন আরো আধুনিক হয়ে বিভিন্ন ঝাঁ চকচকে শপিংমলেও বিকোচ্ছে,সেই কাঁথায় থাকছে রবি ঠাকুরের কবিতা,গান,গল্পের ছবি বাংলার নিজস্ব লোক ঐতিহ্যের ছবি; বিভিন্ন পাঞ্জাবি, কূর্ত্তা,চুড়িদার,শাড়িতেও থাকছে কাঁথা স্টিকের কাজ। এই কাঁথা শিল্প এখন সাধারণ গরীব পরিবারের গ্রাম্য মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়ার মাধ্যম,নিজের মতো বেঁচেথাকার স্বপ্ন আর সাধ্য মতো স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে সংসারের একটু হাল ধরা,অনেক সময় আবার অসহায় বিধবা বা স্বামী বিচ্ছিন্না মহিলাদের ক্ষেত্রে রোজকার রোজগারের একমাত্র অবলম্বন।
------------------------------
বিঃদ্রঃ এই প্রবন্ধটি আনন্দবাজার পত্রিকার বর্ধমান পৃষ্ঠায় প্রকাশিত,এখানে কিছুটা পরিবর্তিত,এই লেখা ও ছবি অন্য কোথাও প্রকাশ নিষিদ্ধ।
No comments:
Post a Comment