Wednesday, April 24, 2019

   খুল্লনার মজ্ঞল চণ্ডী

                     

          মঙ্গলকোটের নতুন হাটের নিকট কোগ্রামে উজানী,মহাতীর্থ একান্ন পীঠের অন্যতম এক পীঠ।পুরাণ অনুযায়ী শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীদেবীর শরীরের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়েছিল,এর মধ্যে দেবীর ডান কব্জি পড়েছিল এই উজান নগরে।এখানের মন্দিরে রয়েছে দেবী মজ্ঞল চণ্ডী এবং ভৈরব কপিলেশ্বরের প্রস্তর মূর্তি।কালিকা পুরাণ অনুযায়ী দেবী চণ্ডী এই পবিত্র সতী পীঠস্থানে কালীরুপে ভক্তকে আশীর্বাদ দেন,মনষ্কামনা পূরণ করেন।এখানের কালী পূজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো,পূজার সময় দেবীর কোন মূর্তি থাকে না,ঘটের মাধ্যমেই দেবী পূজিত হন,ভোগে দেওয়া হয় মাছ।
               মঙ্গল কাব্যের ধারার চণ্ডী মঙ্গল কাব্যের কাহিনীসূত্র অনুযায়ী স্বর্গের অপ্সরা রত্নমালা অভিশাপে স্বর্গাভ্রষ্টা  হয়ে মানবী খুল্লনা নাম ধারন করে পতিত হয়েছিল এই উজানী স্থানে,প্রাচীন অজয় নদের তীরে সাগরের উজানে এ স্থান,তাই উজান নগর।কবিকঙ্কনের চণ্ডী মজ্ঞল কাব্যে উজানী নগরের প্রসঙ্গে আছে-
"উজানী নগর          অতি মনোহর
        বিক্রম কেশরী রাজা।
করে শিব পূজা          উজানীর রাজা
          কৃপাময়ী দশভূজা।।"
রাজা বিক্রম কেশরীর উজানী রাজ্যের ধনবান বণিক ধনপতি সদাগর।স্ত্রী লহনা থাকতেও তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন সুন্দরী খুল্লনা কে,দুই সতীনের কলহ ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার।একবার ধনপতির বাণিজ্য যাত্রার প্রারম্ভে স্ত্রী খুল্লনা স্বামীর মজ্ঞল কামনায় দেবী চণ্ডীর পূজার আয়োজন করেন,কিন্তু পরম শিব ভক্ত ধনপতি লাথি মেরে পূজার ঘট উল্টিয়ে ফেলে বাণিজ্যে বেড়িয়ে যায়, সে যাত্রায় বেড়িয়ে তিনি চরম বিপদে পড়েন,আর ফিরে আসা হয় না।ঘটনা ক্রমে ধনপতি সিংহল রাজার কারাগারে বন্দী হয়ে থাকে।স্বামীর বিরহে চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে খুল্লনা মজ্ঞল চণ্ডীর পূজা করে যেতে থাকেন।বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হয়,খুল্লনার পুত্র শ্রীমন্ত বড়ো হয়ে সিংহল থেকে পিতাকে মুক্ত করে আনেন।
            শ্রীমন্ত যে স্থানে সিংহল যাত্রার আগে মাতা খুল্লনার আশীর্বাদ গ্রহন করে ছিলেন সে স্থানকে বলা হয় 'শ্রীমন্তের ডাঙা ',এ ছাড়াও আরো আনেক জায়গার নাম এখানে আজো সেই প্রাচীন ঐতিহ্য গাঁথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমন-' বিক্রমাদিত্যের ডাঙা ',খুল্লনার ' ছাগল চড়ানোমাঠ ',খুল্লনার রান্না ভাতের হাড়ি থেকে 'মার গড়া মাঠ ',মজ্ঞল কাব্যে উল্লেখিত ' ভ্রমরার দহ ' যেখানে ধনপতির বাণিজ্যতরী ভাসানো থাকতো ইত্যাদি।এইভাবে প্রাচীন অনুসঙ্গ,পোরাণিক মাহাত্মের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যে উজানীর মজ্ঞল চণ্ডীর পূজা বর্ধমান ও পার্শ্ববর্তী বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে ভক্তদের কাছে খুবই শ্রদ্ধার ও জনপ্রিয়।







বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঁথা শিল্প


                       ফিরোজ আলী কাঞ্চন


         বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঁথা শিল্পের কাজ শিখতে কিছু দিন আগে  আষ্ট্রেলিয়ার সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা লিজা উইলিয়াম ও  কুড়ি জন পড়ুয়ার একটি দল এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলেন বর্ধমান শহরের কালীবাজারে আয়োজিত এক বুটিক কর্মশালায়(৮/২,জেলার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত)।এ থেকে প্রমাণিত কাঁথা শিল্প আজ শুধু বাংলা বা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই,বিদেশেও এর নান্দনিক সৌন্দর্য ক্রমশ বিকশিত।
" সোনা মা আমার! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন খাও মাথা,/ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা।/একটু আমারে ধর দেখি মাগো,সূচ সুতা দাও হাতে,/শেষ ছবিখানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে।"-- কাঁথার কথা বললেই মনে পড়ে যায় প ল্লী কবি জসীম উদ্দিনের 'নকসী কাঁথার মাঠ ' কাব্য কবিতার কথা।বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব লোকশিল্প এই  কাঁথা শিল্প,বজ্ঞ নারী এই কাথার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেন বাংলার শিল্প,সংস্কৃতি, সমাজ ও সভ্যতার নানা রুপ ; লোক সংস্কৃতির এক উল্লেখ যোগ্য নিদর্শন হলো এই কাঁথা।
           অল্প শিতে গায়ে দেওয়ার জন্য বা বচ্ছাদের শোয়ানোর কাজে বিছানোর জন্য এই কাঁথার ব্যবহার।এছাড়াও মেঝেতে বিছিয়ে খাওয়ার কাজে দস্তরখানা রুপে বা খাবার রাখার পাত্রের ঢাকনা হিসেবেও পাতলা কাপড়ের উপর  সুতোর সূক্ষ্ম কারুকর্ম ফুটিয়ে তুলে কাঁথার ব্যবহার করা হয়।মূলত গ্রামবাংলার সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন বিত্ত মহিলাদের সাংসারিক এক উপকরণ হিসেবে এর উৎপত্তি,পুরানো কাপড়কে পরিস্কার করে কেচে তার উপর মেয়েলি হাতে ফুল,লতাপাতা,চাঁদ,তারা,বিভিন্ন পশু পাখির নকশা সূচ সুতোর মাধ্যমে রঙ বেরঙে ফুটিয়ে তুলে আবার নতুন করে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠে এই কাঁথা,এখন অবশ্য কাঁথা হচ্ছে নতুন কাপড় সুতোতে। এই কাঁথা আবার পবিত্র কোরান শরীফের ঢাকনা,নামাজ পড়ার জায়নামাজ বা পুজার আসন রুপেও ব্যবহার করা হয়।
        কাঁথার বিভিন্ন নাম- সুজনি কাঁথা,নকশী কাঁথা,লোহিরা কাঁথা ইত্যাদি।সুজনি কাথায় থাকে স রু সুতোর সূক্ষ্ম কাজ,এই কাঁথা প্রচুর সময় ও শ্রম সাপেক্ষ।বাংলার মহিলা মহল পাড়া ঘরে অলস দুপুরে মা-ঝি জা-ননদের দল মিলে কেচ্ছা গাইতে গাইতে আপন খেয়ালে মনের মাধুরী মিশিয়ে দিনের পর দিন ধাপে ধাপে এই কাঁথা বুনে যেতেন।আর নকশী কাঁথায় থাকে নকশার বাহার,একাধিক শাড়িকে স্তরে স্তরে সাজিয়ে তার উপর বিভিন্ন নান্দনিক নকশা মেয়েলি হাতের বুননে এ কাঁথায় ফুটে উঠে।কাঁথার বুননে যেন প্রকাশ পায়  মহিলা মহলের সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না,ব্যাথা-বেদনার অব্যক্ত অনুভূতি গুলি-" পাণ্ডুর হাতে সূচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে,/আঁকিয়ে আঁকিয়া আঁখি জল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে "

             মেয়ে জামায়ের বাড়িতে পাঠানোর জন্য
মায়েরা বিয়ের কয়েক বছর  আগে থেকেই একটা একটা করে কাঁথা বুনে রাখতেন, ছোট বেলায় দেখেছি মা মাসি পিসির কাকীরা মেঝেতে পা মেলে বসে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে সুতো গতিয়ে পুরানো কাপড়ের পাড় থেকে রঙিন সুতো ছাড়িয়ে হাতের আঙুলের বিভন্ন কায়দায় গুটিয়ে সে সুতো সংগ্রহ করতেন।এখন আর সে সবের  চল নেই।তবে আশার কথা
  আধুনিকতার স্রোতে বাংলার অনেক লোকশিল্পের অস্তিত্ব বর্তমানে বিপন্ন হলেও,এই ঐতিহ্যময় সূচিশিল্প কিন্তু আজো পুরোপুরি  হারিয়ে যায়নি।নিজস্ব ঐতিহ্যে বাংলার এই লোকশিল্প জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।  ' প্রচেষ্টা ' নামে একটি সংগঠন বিভিন্ন স্কুলছুট ছাত্রী,বিধবা,বিবাহ বিচ্ছিন্না,সাধারণ গৃহবধূ ও মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে মহান ব্রত পালন করে চলেছেন।কাটোয়ার আলমপুরের অর্জুনডিহি গ্রামে ' আয়েসা ' নামে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা কাঁথাবুনে স্বয়ম্ভর হচ্ছেন।গলসি ব্লকের খেতুড়া গ্রামের সংখ্যালঘু মহিলাগোষ্ঠী গুলিকে সরকারী  ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ,গলসি মহিলা সমাবায় সমিতির 'আনন্দধারা' গোষ্ঠীর সদস্য রা প্রশিক্ষন পেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন মেলায় স্টলের ব্যবস্থা করে নিজেদের হাতের কাজ জন সম্মুখে তুলে ধরছেন।
'কঙ্কন'  স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য শাহনারা সেখ জানালেন,' সরকারী ভাবে শুধু প্রশিক্ষণ নয়,আমাদেরএক লাখ,একটু পুরানো হলে তিনলাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে।'রাজিয়া খাতুন জানালেন, "ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা থেকে সংসারের টুক টাক খরচ আমরা নিজেরাই চালিয়ে নিচ্ছি।'
  
               স্থানীয় বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী মেলায় এঁদের স্টল বসে।কাঁথা এখন আরো আধুনিক হয়ে বিভিন্ন ঝাঁ চকচকে শপিংমলেও বিকোচ্ছে,সেই কাঁথায় থাকছে রবি ঠাকুরের কবিতা,গান,গল্পের ছবি বাংলার নিজস্ব লোক ঐতিহ্যের ছবি; বিভিন্ন পাঞ্জাবি, কূর্ত্তা,চুড়িদার,শাড়িতেও থাকছে কাঁথা স্টিকের কাজ। এই কাঁথা শিল্প এখন সাধারণ গরীব পরিবারের গ্রাম্য মহিলাদের স্বনির্ভর  হওয়ার মাধ্যম,নিজের মতো বেঁচেথাকার স্বপ্ন আর  সাধ্য মতো স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে সংসারের একটু হাল ধরা,অনেক সময় আবার অসহায় বিধবা বা স্বামী বিচ্ছিন্না মহিলাদের ক্ষেত্রে রোজকার রোজগারের একমাত্র অবলম্বন।
------------------------------------------------------------------
বিঃদ্রঃ   এই প্রবন্ধটি আনন্দবাজার পত্রিকার বর্ধমান পৃষ্ঠায় প্রকাশিত,এখানে কিছুটা পরিবর্তিত,এই লেখা ও ছবি অন্য কোথাও প্রকাশ নিষিদ্ধ।

Monday, April 22, 2019

       প্রাচীন জনপদ গলসি
                   

রাঢ় বাংলার মধ্যমণি বর্ধমান জেলার এক প্রাচীন জনপদ গলসি।এই অঞ্চলের জনজীবন ঐতিহাসিকতা, সংস্কৃতিগত বৈচিত্র ও লোকায়ত ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। চৈনিক পপর্যটক  হিউয়েন সাং তাঁর গ্রন্থে গলসি অঞ্চল কে ' উতুপ্রদেশ ' নামে চিহ্নিত করেছেন।
           গলসি অঞ্চলের নামকরণ কিভাবে হলো তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।অনেকে বলেন গ্রাম্য দেবতা গর্গেশ্বর শিবের নাম থেকে গ্রামের নাম হয়েছে গলসি,ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন 'গলশাশী' শব্দ থেকে গলসি নাম এসেছে;বহু পূর্বে এ অঞ্চল ছিল গভীর শাল বনের জজ্ঞল,তখন ঠ্যাঙারেরা পথচারীদের হত্যা করে সে জজ্ঞলে পথের দুপাশে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতো সেই গলায় রসি থেকে গলসী নাম হয়েছে।অনেক গবেষকে মত সামন্ত রাজা ময়গল সিংহের নাম থেকে অঞ্চলের নাম হয়েছে গলসি।
               গলসি অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মল্লসারুল গ্রামে জারুল নমক এক পুকুরে মাটিতোলার সময় পাওয়াযায় বঙ্গদেশের প্রাচীনতম তাম্রপট্ট লিপি ' মল্লসারুল লিপি ',যেটি আসলে একটি ভূমিদান পত্র।ননীগোপাল মজুমদারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এতে পাশাপাশি বেশ কিছু গ্রামের সসম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরগণের কাছ থেকে কিনে তা কৌণ্ডিন্য গোত্রের ব্রাম্ভণ বৎসস্বামীকে প্রদান করা হয়েছিল।এখানে উল্লেখিত মহারাজ বিজয়সেনের রাজত্ব কাল৫০৭-৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দ। বর্ধমান জেলার ইতিহাসে এই লিপির তাৎপর্য ব্যাপক,মল্লসারুল লিপিতেই প্রথম বর্ধমান ভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।এই লিপিতে উল্লেখিত কিছু গ্রামের প্রাচীন নাম পাওয়া যায়,যেমন- মল্লসারুল>আম্রগর্তিকা,কইতাড়া>কবিন্থবাটক,মহড়া> মধুযাটক,আদড়া>অধিঝকরক,বাকতা>বককক্ততক ইত্যাদি।
          খানো গ্রামে বাঘা রাজাদের ঢিবি থেকে কিছুদিন আগে আবিস্কৃত হয়েছে  প্রায় দুহাজার বছর পূর্বের মাটির পাত্রের বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ। জগৎরায় মুঘল সম্রাট আলমগীরের কাছথেকে যে ৪৯ টি মৌজার জমিদারিত্ব পেয়েছিলেন সেখানে ' বাঘাপরগনা ' বলে গলসির উল্লেখ আছে।খানোতে এই বাঘারাজবাড়ি যাবার ছিল দুটো পথ,যেটি প্রধান মোড় ছিল সে মোড়ে গড়েউঠা গ্রামটির বর্তমান নাম' বড়োমাড়',আর অপেক্ষ্যাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ গ্রামটির নাম ' ছোটমোড় '।
        মূল গলসি গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য শিবের শিখর দেউল ও দুর্গামন্দির।গ্রামের একেবারব মাঝখানে আছে আটকোনা শিবমন্দিরে গ্রাম্য দেবতা গর্গেশ্বর,এছাড়াও পাড়ায় অন্যেক দালান মন্দিরে আছে ধর্মরাজের শিলামূর্ত; শ্রাবণ মাসে গ্রামে ধর্মরাজ ও গর্গেশ্বরের গাজন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়।এই গাজনের এক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে,গ্রামের মিড়িকপাড়ার মসজিদের সামনে ছাড়া এ দেবতা পূজা নেন না,যা হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এক উজ্বল দৃষ্টান্ত।
         ধর্মঠাকুর ক্ষেত্রপালের নাম অনুসারে 'ক্ষেত্রপুর ' থেকে খেতুড়া গ্রামের নাম হয়েছে,খানো গ্রামের ঈশান কোণে রেললাইনের ধারে দেবী ঈশানচণ্ডীর থান,উড়ো গ্রামে পাঠান ও মোগল যুগে পথিকদের বিশ্রামস্থল রুপে ব্যবহৃত হত বলে ' চটি ' নামে পরিচিতি লাভ করেছে,এই উড়ো গ্রামে  রয়েছে রায় পরিবার প্রতিষ্ঠিত দুর্লভ সিংহবাহিনী মহিষাসুর মর্দিনী জয়দুর্গার বিগ্রহ,কালাচাঁদ নামে ধর্মরাজের গাজনও হয় গ্রামে।বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় পুষ্ট ইড়কোনা গ্রামে প্রতি বছর রাধাকৃষ্ণের স্মরণে মেলা বসে।গোহগ্রামের প্রাচীন দেবকীর্তি হলো ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত চক্রবর্তী পরিবারের দালান মন্দির,মন্দিরে আছে রাধাদামোদারের শালগ্রাম শিলা,মন্দির গাত্রের টেরাকোটার সৌন্দর্য খুবই আকর্ষণীয়।আদরেশ্বর শিবের নাম থেকে গ্রামের নাম হয়েছে আদড়াহাটি,আদরেশ্বর শিবলিঙ্গটি খুবই প্রাচীন ও বিরল ধরনের।পিতল কেন্দ্রিক দ্রব্যসামগ্রীর জন্য কৈতাড়া গ্রাম বিখ্যাত,কুরকুবা গ্রামে দালান মন্দিরে কমলা নামে মনসাদেবীর পাষাণ মূর্তি, পুজো উপক্ষে প্রতি বছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মেলা বসে,গ্রামের মাজেদ মোল্লা নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে জলসেচের দুনি ও আখমাড়াই কল তৈরী করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
         সাঁকো গ্রামে আছে সূর্য মূর্তি ঊষাদিত্য,প্রথম মহাভারতের ইংরাজী প্রকাশক (১৮৪১) শ্রদ্ধেয় প্রতাপচন্দ্র রায় ছিলেন এই গ্রামেরই বাসীন্দা।মধ্যযুগের বিখ্যাত শাক্ত কবি সাধক কমলাকান্ত থাকতেন চান্না গ্রামে,আবার মানিকতলা বোমা মামলার অন্যতম সংগঠক ঋষি অরবিন্দের সহযোগি যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বা স্বামী নীরালাম্বের আশ্রম এই চান্নাতের খড়ি নদীর তীরে অবস্থিত।অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের বিখ্যাত নারী পণ্ডিত রুপমঞ্জরী ছিলেন মারো কোটা গ্রামের বাসীন্দা।'শনিবারের চিঠি' পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের জন্মস্থান বেতালবন গ্রামে।
         গলসি অঞ্চলের ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ নিদর্শন গুলির মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ভুড়ি গ্রামে রয়েছে প্রায় পাঁচশো বছরের প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, আদড়াহাটি গ্রামে ও জাগুলিপাড়া গ্রামে তিন গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ।সিমনোড় গ্রামে পীর গরীব দান বাবা,স্টেশন রোডে হজরত বাবর আলী শাহ এলাকার উল্লেখযোগ্য পীর আউলিয়ার মাজার।
      রাঢ বঙ্গের লোকসংস্কৃতির প্রায় সব অঙ্গ উপাঙ্গ গুলিই এ অঞ্চলে দেখাযায়-ভাদু,তুসু,লেটো,ভাসানের গান,সত্যপীরের পালা ইত্যাদি লোকো ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ গলসি।
                   ----

                  ধর্মরাজের গাজন

                     বেলানের প্রাচীন মন্দির


                         জয়কৃষ্ণ পুরে কেন্দুলি
                           কসবা সাঁতালি পর্বত

                       চান্না স্বামী নীরালম্বের আশ্রম
                    কৈতাড়া গ্রামে পিতলেরকাজ
                           লোকবিশ্বাস
                           চৌমাথা
                     শাহপীর তলা
                        খড়ি নদী

বিঃদ্রঃ    এই প্রবন্ধটি আনন্দবাজার পত্রিকার জেলার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত,এখানে কিছুটা পরিবর্তিত।এই লেখা ও ছবি অন্য কোথাও প্রকাশ সম্পূর্ণ ভাবে নিষেধ।
       
        

Sunday, April 21, 2019



গলসীর ধর্ম রাজের গাজনে হিন্দু -মুসলিম মিলনের বার্তা।
                        ফিরোজ আলী কাঞ্চন
         সারা দেশে যখন হিন্দু মুসলিম বিভেদের বাতাবরণ, তখন বর্ধমান গলসীর ধর্মরাজের গাজন যেন এক বিভেধহীন মিলন ক্ষেত্র।
    বাংলার আঞ্চলিক দেবতা ও লোকসংস্কৃতিতে যে দেবতাদের প্রাধান্য তাদের মধ্যে অন্যতম ধর্ম ঠাকুর।রাঢ় বজ্ঞের অনান্য গ্রামের মতো এই অঞ্চলের মূলগলসীছাড়াওইড়কোনা,বেলান,আদড়াহাটি প্রভৃতি গ্রামে ধর্ম ঠাকুর পুজিত হন।ধর্ম ঠাকুরের সজ্ঞে শিবও এ অঞ্চলে জনপ্রিয়।মূল গলসি গ্রামে রয়েছে গর্গেশ্বর শিব।আটকোনাকৃতি প্রাচীন শিখর মন্দির।অনেক গবেষক মনে করেন এই গর্গেশ্বর শিবের নাম থেকেই গ্রামের নাম হয়েছে গলসী।
           ধর্ম ঠাকুরের প্রকৃতি নিয়ে
    মতভেদ থাকলেও ধর্ম ঠাকুরের সজ্ঞে আজ্ঞিকগত সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য শিব ঠাকুরের।গলসীতে শিব ও ধর্মরাজ এক সজ্ঞে পূজিত হন।গ্রামের এক দালান মন্দিরে ধর্মরাজের অবস্থান,প্রাচীন এই দালান মন্দিরটি কতোসালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা সঠিক ভাবে জানা গেলেও এটুকু বোঝাযায় মন্দিরটি ১৯২০সালে সংস্কার করা হয়েছিল।গলসীতে চৈত্রমাসে শিবের পুজো না হয়ে শ্রাবণ মাসের শেষ সোম ও মজ্ঞল বার ধর্মরাজ ও গর্গেশ্বর শিব এক সজ্ঞে পুজাপান।এ উপলক্ষ্যে এক বিরাট মেলা বসে,রাত্রে ঝোলা হয়,দিনে বানেশ্বর রাড় হয়।সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট ধর্মরাজের মূর্তিট সারাদিন গ্রামের এক প্রান্তে এক মসজিদের সামনে রেখে পুজো করা হয়েথাকে,এই রীতি কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে,যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্বল দৃষ্টান্ত।এ ছাড়াও গলসীর এই চড়কের মেলাতেও যেন হিন্দু মুসলমানের মিলন ক্ষেত্র।আসেপাশের গ্রামগুলি থেকে জাতি ধর্মনর্বিশেষে সকলে উপস্থিত হয়ে জাতীয় সংহতির ভীতকে মজবুত করেতুলে।



গলসীর  গ্রাম পরিচিতি
খানো,উড়ো,ইড়কোনা,গোহগ্রাম

*খানো
(জে এল ১৩৯)
                    খানো লিংক স্টেশনের দক্ষিন দিকে রয়েছে এই গ্রাম টি।গ্রামের একেবারে ঈশান কোনে রেললাইনের ধারে দেবী ঈশান চণ্ডীর থান।স্তুপীকৃত ভাংা ইটের ডিবির উপর দেবীর পদচিহ্ন যুক্ত এক পাথর খন্ডকেই ঘিরে দেবীর অবস্থান।

*  উড়ো
(জে এল ১৩৭)
                  জি টি রোডের ধারে অবস্থিত এই গ্রামটি পাঠান ও মোগল যুগে পথিকদের বিশ্রাম স্থল রুপে ব্যবহৃত হত বলে এ স্থান টি "চটি" নামে প রিচিত।এই গ্রামে রয়েছে রায় প রিবারের প্রতিষ্ঠিত এক বিশাল দুগা'র মূতি'।এই ধ রনের বিগ্রহ পশ্চিম বজ্ঞে খুব এক টা দেখা যায় না, ঊনবিংশ শতকে গ্রামের ই বাসিন্দা ম নীন্দ্রনাথ রায় এবং অরুন রায় জোড়া রেখ দেউল রীতিতে শিব মন্দিরটি তৈরী ক রেছিলেন।কালাচান্দ নামে ধম'রাজের গাজন ও গ্রামে হ য়।গ্রামে র য়েছে রায় পরিবারেত প্রস্ত র নিমি'ত ম ন সা মূতি',ভট্টাচায' প রিবারের প্রস্ত র নিমিত' বিশালক্ষী দেবীর মূতি'।

*    ইড়কোনা
(জে এল ১০৩)
              বৈষ্ববীয় ভাব ধারায় পুষ্ট এই গ্রামটির প্রধান ঐতিহ্য প্রতি বছর মাঘ মাসে রাধা কৃষ্মের শ্মরনে মেলা।

*    গোহগ্রাম
(জে এল ৭০)
                   মল্লসারুল লিপিতে এই গ্রামটির নাম রয়েছে "গোধগ্রাম"।গ্রামের প্রাচীন দেবকীতি' হ লো চক্রবতী' পরিবারের দালান মন্দির। প্রতিষ্ঠা লিপি থেকে জানা যায় মন্দিরটি ১৭৯২শকাব্দে বা ১৮৭০ খ্রীঃ নিমি'ত হয়ে ছিল।এই মন্দিরে রয়েছে রাধা দামোদরের শাল গ্রাম শিলা।এই মন্দিরে গাত্রের টেরাকোটার কাজ খুবই সুন্দর
গ্রামে চৈত্র মাসে শিবের গাজন হ য়।

              গলসী অঞ্চলের প্রতি গ্রামে আছে এমন নানা ঐতিহ্য ময় পরিচিতি।আমরা নিজেরা যদি এবাভে নিজের নিজের গ্রামের কথাকে তুলে ধরি তাহলেই সমৃদ্ধ হবে এই প্রচেষ্টা।
                      গোহগ্রামের প্রাচীন মন্দির

                                                                          
দুই বিদুষী হটি বিদ্যালঙ্কার ও রুপমঞ্জরী
                   ফিরোজ আলি কাঞ্চন

       অষ্টাদশ -উনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থা ছিল বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ,কৌলিণ্য প্রথা এমনকি সতীদাহ প্রথার মতো নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষণশীল এই সমাজে নারী জাতি ছিল প্রচণ্ডভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত,ছিল না কোন ব্যক্তি স্বাধীনতা বা সামাজিক মর্যাদা।আর এমতাবস্থায় সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যদিয়েও নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভায় নিজস্ব স্বতন্ত্রতার পরিচয় রেখেছিলেন যে কয়েকজন বজ্ঞীয় রমণী তাঁদের মধ্যে অন্যতমা  যে দুজনা তাঁরা হলেন রাঢ়দেশীয় হটি বিদ্যালঙ্কার ও কুমারী রুপমঞ্জরী দাস; এছাড়া অনান্যরা হলেন পূর্ববঙ্গের বিক্রম পুরের আনন্দময়ী দেবী ও কোটালী পাড়ার বৈজয়ন্তী দেবী।
            হটি বিদ্যালঙ্কার 
          -------------------------
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পূর্ব বর্ধমান জেলার সোঁয়াই গ্রামে এক কুলীন ব্রাম্ভণ পরিবারে হটি বিদ্যালঙ্কারের জন্ম।হটি বিদ্যালঙ্কারের প্রকৃত নাম সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না।বাড়িতে পিতার শাস্ত্র চর্চা দেখে ছেলেবেলায় তিনিও বায়না ধরলেন পড়াশুনা শিখবেন।কিন্তু সে সময়।টোল-চতুস্পাঠীতে মেয়েদের পড়াশুনার প্রচলন ছিল না,তবুও কন্যার জেদে পিতা বাড়িতেই হটিকে ব্যাকরণ, কাব্য ও শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠদান শিখালেন।
     কিন্তু এ পাঠদান বেশিদিন বজায় থাকলো না,মেয়ের বয়স যে বেড়ে চলেছে,স্বভাবতই হটির হয়েগেল বাল্যবিবাহ পার্শবর্তী গ্রামে এক তরুণ পণ্ডিতের সঙ্গে।পিতা যেন হটির জন্য এমন এক পাত্র নির্বাচন করলেন যে তাঁর কন্যার সুপ্ত বাসনাগুলিকে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে।বিবাহের পর তরুণ পণ্ডিত স্বামীর কাছে অনেক রাত্রি পর্যন্ত মগ্ন থাকতেন শাস্ত্রচর্চায়,স্বামীকে বলতেন,' দেখবে তোমাদের মতো আমিও পণ্ডিত হব।'
      এ ধারাও বেশিদিন টিকল না,হঠাৎ ঘটল স্বামীর অকাল প্র‍য়াণ,পিতাও গত হয়েছেন।স্বামী পিতাকে হাড়িয়ে হটি পরিণত হল নিঃসঙ্গ,একাকিনী এক বাল্য বিধবায়।হতাশার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জীবনে বাঁচার রসদ হিসেবে তিনি বেছে নিলেন তাঁর সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবায়িত করার উগ্র ইচ্ছেকে-যে করেই হোক তাঁকে শাস্ত্রজ্ঞ হতেই হবে,শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যাদানে দেশ-বিদেশে বিখ্যাত হয়ে সে যেন স্বর্গীয় স্বামী ও পিতার প্রতি চরম শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করবে।সাহস আর আত্মবিশ্বাসে ভর করে হটি পৌঁছালেন তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র অধ্যায়ণ ও অধ্যাপনার কেন্দ্র কাশীতে।সেখানের বিখ্যাত বিখ্যাত সব পণ্ডিতদের চতুষ্পাঠীতে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে একাগ্র চিত্তে কঠিন অধ্যায়ন করে তিনি আয়ত্ব করলেন জ্যোতিষ বিদ্যা,ন্যায়শাস্ত্র,গণিত,ছন্দোসূত্র প্রভৃতির পাঠ।কাশীর পণ্ডিত সমাজ একজন নারীর এই অসামান্য পাণ্ডিত্য ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এক সম্বর্দ্ধনা সভার আয়োজন করে হটিকে ' বিদ্যালঙ্কার ' উপাধিতে ভূষিত করলেন।হটি বিদ্যালংকার কাশীতে এক চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অধ্যাপনা করতে থাকেন।১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে কাশীধামে এই এই শাস্ত্রজ্ঞ বিদূষী মহিলা পরোলোক গমণ করেন।
            রুপমঞ্জরী দাস
          ------------------------
          অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে আনুমানিক ১৭৭৫খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে পূর্ব বর্ধমানের বুদবুদ থানা অঞ্চলের কোটা গ্রামে এক বৈষ্ণব পরিবারে পণ্ডিত কুমারী রুপমঞ্জরী দাসের জন্ম।মাতা সুধামুখী দেবীর অকাল মৃত্যুতে মাতৃহারা রুপমঞ্জরী ছিলেন পিতা নারায়ণ দাসের কাছে বড়োই আদরের।কন্যার সব চাহিদা পূরণ করার তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন।ছেলেবেলা থেকেই রুপমঞ্জরীর মনে আসত অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন!  যার সব উত্তর  পিতা দিতে পারতো না,যেমন রুপমঞ্জরী জিজ্ঞেস করলো,' আমাদের সমাজে শুধু ছেলেরায় মুণ্ডিত মস্তকে টিকি রাখে,মেয়েরা রাখেনা কেন বাবা?আমিও মাথা মুণ্ডিত করে টিকি রাখবো।'নারায়ণ দাস কন্যার কৌতুহলী প্রশ্নের যুক্তিযুক্ত কোন উত্তর দেতে পারলেন না,তবে কন্যার প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন।মুণ্ডিত মস্তকে একগুচ্ছ টিকিরেখে ধূতি চাদর পরিধান করে ছোট্ট রুপমঞ্জরী যখন পিতার হাত ধরে পথে বেরুতো তখন প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখতো।কিন্তু আরো একটু বড়ো হয়ে রুপ মঞ্জরী যখন বায়না ধরলো সে টোলে ভর্তি হয়ে শাস্ত্র অধ্যায়ন করতে চায় তখন তা যেন পিতাকে বড়োই বিড়াম্বনায় ফেলে।দিল,তবুও কন্যার জেদকে দমালো না।রুপমঞ্জরীর মুণ্ডিত মস্তক আর পোশাক দেখে পণ্ডিত মশায় তো অবাক! তবে তিনি ছোট্ট শিক্ষার্থীনীকে সাদরে গ্রহণ করলেন।
            বিধি যেন বাম।রুপমঞ্জরী যখন পনেরো ষোল বছর বয়স তখন।পিতার মৃত্যু তাঁর জীবনে আনলো চরম আঘাত। মাতাকে সে আগেই হাড়িয়েছে,এবার নারায়ণ দাসের মৃত্যু তাকে করেদিল আরো অসহায়।তবে এই হতাশময় জীবনে রুপমঞ্জরী ভেঙে পড়লেন না,আবার শুরু করলেন পড়াশুনা।আউসগ্রাম অঞ্চলের সর গ্রামে পণ্ডিত গোকুলানন্দ মহাশয়ের টোলে সংস্কৃত সাহিত্য পড়ার জন্য ভর্তি হলেন।এদিকে পিতার মৃত্যুর বর্ষ পূর্তির সময় এসে গেছে।রুপমঞ্জরী পিতার পরলৌলিক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে গেলেন গয়ায়।ক্রিয়া সম্পন্ন করে পৌছালেন কাশীতে।এখানে শাস্ত্র ব্যাখ্যার গভীর তত্ব অধ্যায়নের জন্য ভর্তি হলেন  টোলে।রুপমঞ্জরীর কঠিন সাধনা আর নিরলস পরিশ্রম  আর শাস্ত্র ব্যাখ্যার নতুন তত্ব উদ্ভাবন ক্ষমতা দেখে কাশীর টোল-চতুষ্পাঠীর বিদ্বান পণ্ডিত সমাজ তাঁকে 'তর্কালঙ্কার' উপাধি প্রদান করলেন।
         কাশীর পাঠ সমাপ্ত করে রুপমঞ্জরী আবার ফিরে এলেন জন্মস্থান কোটা গ্রামে, এবং একটি টোল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অধ্যাপনা করতে থাকেন।নানা রাজ্য থেকে আগত ছাত্রেরা রুপমঞ্জরীর টোলে চড়কসংহিতা,ব্যাকরণ,ন্যায়শাস্ত্র,জ্যোতিষ বিদ্যা,কবিরাজি চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যায়ন করতো।প্রায় শত আয়ু অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারিণী এই মহিলার স্বগ্রামে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু ঘটে।বলতে পারি আজীবন কৌমার্য ব্রতচারিণী, জ্ঞানতপস্বিণী রুপমঞ্জরী সর্ব প্রথমা আধুনিকা বজ্ঞ রমনী,যিনি পুরুষের বেশ ধারণ করে মাথায় শিখা রেখে সেই সতীদাহর যুগে বেশে,কর্মে ও যোগ্যতায় নিজেকে এক সম্মানীয়ায় পরিণিতা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
-----------------------------------------------------








চান্না গ্রামে সাধক কবি কমলাকান্ত পূজিত দেবী বিশালাক্ষী 

                        ফিরোজ আলী কাঞ্চন

           যদিও আনুমানিক ১১১৭ সালে(ইং-১৭৭০খ্রিঃ)অম্বিকা কালনায় বাংলা শাক্তপদাবলির অন্যতম কবি সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য জন্ম গ্রহন করেন,কিন্তু অকালে পিতা মহেশ্বর ভট্টাচার্য্যের মৃত্যু হওয়ায় মাতা মহামায়াদেবী তাঁর দুই সন্তান কমললাকান্ত ও শ্যামকান্তকে নিয়ে চলে আসেন বাপের বাড়ি গলসীর চান্না গ্রামে।মামা নারায়ণ ভট্টাচার্য্য এঁদের বেশকিছু জমি গবাদি পশু প্রদান করেন।কবির পৈতে দিয়েছিলেন এই মামা নারায়ণ ভট্টাচার্য্য।কমলাকান্তের ' সাধকরঞ্জন ' গ্রন্থে পাওয়া যায়--
          ' অতপর কহিশুন আত্মনিবেদন।
           ব্রাম্ভণ কূলে উপনীত স্বামী নারায়ণ।'
              এই সময়য় চান্না গ্রাম ছিল শিক্ষা দীক্ষ্যার পীঠস্থান।কমলাকান্ত গ্রামের টোলে ব্যাকরণ শাস্ত্র অধ্যায়ন করেনে এবং পরে তিনি নিজে একটি টোল প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাপনা করতে থাকেন।কমলাকান্ত অবসর সময়ে গ্রামের মেঠো পথে উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াতেন।পুত্রের সংসারের প্রতি উদাসীনতা দেখে মাতা মহামায়াদেবী কমলাকান্তের বিবাহ দিয়েদেন বর্ধমানের লাকুড্ডিতে ভট্টাচার্য্য পরিবারে।
                বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও সংসারী হতে পারলেন না কমলাকান্ত।সর্বদা গ্রামের বিশালাক্ষী মন্দিরে উদাস মনে বসে থেকে ' মা-মা ' বলে ডাকতেন।মন্দির সংলগ্ন পুকুরপাড়ে বায়ুকোণে এক পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে সাধনায় মগ্ন থাকতেন।সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে কমলাকান্তের খ্যাতি বহুদূর ছড়িয়ে পড়ল।এদিকে দারিদ্র যেন নিত্য সজ্ঞী,সংসারে অভাব যেন দিনের দিন বেড়েই চলল।সাধকের এক অবস্থাসম্পন্ন ধনী ভক্ত চান্নায় এসে গুরুর আর্থিক দুরাবস্থা দেখে আবার কালনায় নিয়ে যান।সেখানেও কবি এক পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনা শুরু করেন।কিন্তু এখানের অবস্থান সুখকর হয় না,কিছুদিনের মধ্যেই মাতা মহায়াদেবীর মৃত্যু ঘটে।কবি ফিরে আসেন চান্নায়,এখানে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই আবার এক দুর্ঘটনা,বিপত্নীক হন কবি।
         কমলাকান্ত দ্বিতীয় বিবাহ করেন কাঞ্চন নগরে,এই স্ত্রীর গর্ভে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।দারিদ্র তবুও যেন পিছু ছাড়ে না,সবদিন চালও জুটটো না,এমনই এক অভাবের দিনে এক শ্যাম বর্ণা মহিলা সাধকের বাড়িতে হাজির,সজ্ঞে দুই লম্বা চওড়া লোকের মাথায় ঝুড়ি ভর্তি চাল,আলু তরিতরকারী।কমলাকান্তর চান্না অভস্থান কালে প্রচলিত আছে এমনি সব কাহিনী।আরো প্রচলিতলিত আছে যে বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরের পুজোয় শোল ও মাগুর মাছ লাগবেই,কিন্তু কোথাও মাছ পাওয়া যাচ্ছে না,এমন সময় শুনলেন পাশের পুকুরে জলের থেকে কারো উঠে আসার শব্দ,দেখলেন এল কালো কুচকুচে মেয়ে মাছ নিয়ে হাজির,হাসতে হাসতে বললো, ' আমি বাগদি পাড়ার মেয়ে গো,শুনলাম পুজোর জন্য তুমি কোথাও মাছ পাচ্ছো না,তাই দিতে এলাম,'।সাধক বললো,' কিন্তু আমার কাছে যে এখন পয়সা যে নেই মা ',বাগদি মেয়ে বললো,' সে তুমি কাল পাড়ায় দিয়ে এসো।'পরের দিন সারা বাগদি পাড়া তন্ন তন্ন করেও সেই কন্যার দেখা পাওয়া যায়নি।
           সাধক কমলাকান্তের মহিমার কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকলো দিকে দিকে।দেওয়ান রঘুনাথ রায়ের পরামর্শে বর্ধমানের মহারাজ তেজচাঁদ তাঁর রাজসভার সভাকবি রুপে নিযুক্ত করেন সাধক কবি কমলাকান্তকে।মহারাজ কমলাকান্তকে কোলাহাটে একটা মায়ের মন্দির নির্মান করেদেন এবং বাৎসরিক বৃত্তির বন্দোবস্ত করেদেন।সাধকের জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের।

-----------------------------------------




নূর জাহান,জগতের আলো,যুবরাজ সেলিমের প্রেমিকা।কিন্তু আকবর ভাবলো সে মুগল সম্রাট,তার পুত্র কি না বিয়ে ক রবে এক সামান্য কম'চারীরর মেয়েকে?চালাকি করে মেহের উন্নিসার বিয়ে দিয়ে দিল্লী থেকে দূরে পাঠিয়ে দিলেন।ব ধ'মানে।সের আফগানের সজ্ঞে বিয়ে দিয়ে।কিন্তু সেলিম যখন স ম্রাট হ লো,ম নে প ড়লো মেহের কে,।তার পর সের আফগানকে হত্যা ক রে মেহের উন্নিসাকে নিয়ে যাওয়া হ লো দিল্লী।
(ছবিতে বর্ধমানে শের আফগান ও কুতুবউদফিনের সমাধি,পীর বাহারাম মাজার।)








গলসী শাহপীর তলা,পীর বাবর আলী শাহর মাজার,হিন্দু মুসলিম সকলের কাছে জনপ্রিয় এই মাজারের প্রাকৃতিক রুপ সত্যি অতুলনীয়।






মঙ্গলকোট বর্ধমান জেলার সবচেয়ে ঐতিহাসিক স্থান।এখানের কিছু ঐতিহ্যের চিত্র দিলাম
                   হামিদ বাঙালীর মাজার

                     নতুন হাটে প্রাচীন মসজিদ


                       আঠারো আউলিয়ার                              অন্যতম রাহিপীরের মাজার


                      বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে বুড়ো পীর
                       কোগ্রামে কবি কুমুদ রঞ্জন                         মল্লিকের জন্মস্থান
                   অজয় নদের ধারে কবির বাড়ি

                  বৈষ্ণব কবি লোচন দাসের                           সমাধি