Saturday, May 2, 2020





         অরণ্যসুন্দরী ভাল্কি মাচান
     
                                                   ফিরোজ আলী কাঞ্চন

গ্রীষ্মের ধূ-ধূ ধরন হোক বা শীতের হালকা রোদ্দুরের কোমল আমেজ অথবা বর্ষার বৃষ্টিধোয়া সবুজের সমারোহে ;সব ক্ষণে সব ঋতুতে আমাদের সুদূর পিয়াসী মন পেতে চায় প্রকৃতির স্পর্শ,প্রবেশ করতে ইচ্ছে করে গভীর গহনে; তা একাকী নির্জনে হোক বা প্রিয়জন-পরিবারের সাথে। সেই আহ্বানেই একদিন দেখে আসতে পারেন শান্ত নির্জন প্রকৃতির মধ্যে পাখিদের কলতান আর শাল,পিয়াল গাছালির সারির গভীরের নিস্তব্ধ পরিবেশে মোড়া পূর্ব বর্ধমান আউসগ্রাম থানা অঞ্চলের অরণ্যসুন্দরী ভালকি মাচান।প্রাচীন এই জঙ্গলকে নিয়ে স্থানীয় গ্রামগুলির জনগণের মধ্যে প্রচলিত আছে অদ্ভুত সব রোমাঞ্চকর রূপকথা।
            জঙ্গল নিকটস্থ প্রাচীন জনপদ অমরারগড় ছিল গোপ রাজাদের রাজধানী। লোকশ্রুতি এই গ্রামের এক পূর্ণগর্ভা সদগোপ মহিলা জঙ্গলের ধারে এক পুকুরে জল আনতে গিয়ে ভাল্লুকের দ্বারা আক্রান্ত হয়,ভাল্লুক গগর্ভবতী মহিলাকে টেনে নিয়ে যায় বনের মাঝে নিজের বাসায়;সেখানে সে মহিলাটিকে ভক্ষণ করে,সেই সজ্ঞে গর্ভবতী মহিলাটির শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়।ভাল্লুকটি কিন্তু সেই শিশুর কোন ক্ষতি করে না।পরেরদিন এক ব্রাম্ভণ জজ্ঞলের সেই পথ ধরে যাচ্ছিলেন।হঠাৎ ঝোপের আড়ালথেকে শিশুর কান্না শুনে তিনি থমকে দাঁড়ালেন।সর্তপনে এগিয়েগিয়ে দেখলেন এক সদ্যজাত,পরম  মমতায় বুকে তুলে এনে তিনি সেই শিশুটিকে বাড়ি ফিরে এসে গিন্নির আঁচলে তুলেদিলেন।ব্রাম্ভনের স্ত্রীর কোন সন্তানাদি ছিল না,তাই তার মাতৃস্নেহ যেন উথলে উঠল।ব্রাম্ভনীর কাছেই বড়োহয়ে উঠল ছেলেটি।ভালুকের বাসাথেকে পাওয়া গেয়েছিল বলে এর নাম রাখাহয়েছিল ভাল্লুপাদ।এই ভাল্লুপাদ পরে এই অঞ্চলের রাজা হয়েছিল,ইনি ছিলেন গোপ রাজাদের পূর্বপুরুষ। 'পাদ ' অর্থ পূজনীয়,চর্যাপদের কবিদের নামে শেষে যেমন 'পাদ ' থাকে সেই অর্থে।
       আবার অনেকে বলেন এক ভাল্লুকী এই জজ্ঞলের মধ্যে এক মানব সন্তান কুড়িয়ে পায় এবং সে মাতৃস্নেহে শিশুটিকে বড়ো করে তুলে।পূর্ণ বয়েসে শুশুটি হয়েউঠল ভাল্লুকের মতো বীর ও শক্তিশালী। ভাল্লুকের স্তন্যপানে শিশুটি বড়োহয়ে উঠেছিল বলে নাম হয়েছিল ভাল্লুপাদ,এবং পরে তিনি এই অঞ্চলের রাজা হয়েছিলেন ও এক সদগোপ কণ্যাকে বিবাহ করেছিলেন। আবার অন্যমতে ভাল্লুপাদর পা গুলোছিল ভাল্লুকের পায়ের মতো,ইনি ছিলেন রাজপুত সন্তান।বিকৃত পা নিয়ে জন্মানো এমন সন্তান কে তার পরিবারের লোকেরা লোকলজ্জার ভয়ে জঙ্গলে ফেলেদিয়ে আসে এক ভাল্লুকের গর্তে।কিন্তু এক নিঃসন্তান ব্রাম্ভন শিশুটিকে কুড়িয়ে পেয়ে বাড়ি নিয়ে এসে লালন পালন করেন।
          প্রকৃত ঘটনা যা হোক না কেন,এই জজ্ঞলে এক কালে যে প্রচুর পরিমানে ভাল্লুকের বাস ছিল এ কথা নিশ্চিত।বর্ধমানের মহারাজেরা এই জজ্ঞলে ভাল্লুক শিকার করতে আসতেন।আজো এখানে দেখতে পাবেন একটা পোড়া ইটের তৈরী ভগ্নপ্রায় টাওয়ার বা মাচা,যা এ জজ্ঞলের এক বাড়তি আকর্ষণ।এই মাচার নীচে আছে এক সুড়ঙ্গ, জনশ্রুতি এই সুড়ঙ্গের সঙ্গে নাকি বর্ধমানে শাহাচেতনপুরের শের আফগানের সমাধির নিকট অবস্থিত সুড়ঙ্গ পথের যোগাযোগ রয়েছে।আসলে প্রাচীন যুগথেকে মাটির নীচে সুড়ঙ্গ পথের একটা যোগ বর্ধমান জেলায় পাওয়া যায়,দুর্গাপুরে সিটি সেন্টারের নিকট ভবানীপাঠক দেবীচৌধুরানী পূজিত মন্দিরের নিকটেও এক সুড়ঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়,এগুলি কোন একসূত্রে যুক্ত কিনা তার কোন অনুসন্ধান এখনো পর্যন্ত হয়নি।


অরণ্যসুন্দরী ভাল্কি মাচানের গভীর নিস্তব্ধতায় প্রাকৃতিক পরিবেশের মনোরম সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই।প্রতিবছর শীতকালে এখানে পিকনিক করতে দূর দূরান্ত থেকে আসে পর্যটকদের দল।মাচানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে নির্মিত হয়েছে একটি পার্ক,মাচানের প্রবেশমুখে প্রতিষ্ঠিত এক ভাল্লুকের মূর্তি,যদিও এখন আর ভাল্লুকের দেখা মেলেনা।পার্কের মাঝে এক বড়ো দিঘী,এখানে বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে।হরেক ফুল আর ঝাউগাছের সারিদিয়ে ঘেরা দিঘী এ অরণ্যের মাঝে যেন এক আলাদা নৈসর্গিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।এ অঞ্চলের বিরাট বনভূমি যেন শহুরে ইঁট পাথরের ব্যস্তময় একঘেয়েমি জীবনের নিকটেই এক টুকরো সবুজের সমারোহ,বনের মাঝে আবার আছে বিভিন্ন ছোট ছোট আদিবাসীদের গ্রাম।জঙ্গলে শালপাতা আর শুকনো কাঠ কুড়িয়ে যাঁরা জীবিকা নির্বাহ করে।

যে কোন ছুটির সময়ে আপনার সেরা গন্তব্য হতেপারে অরণ্যসুন্দরী ভালকি মাচান,আর রাত্রের নিঝুমে জজ্ঞলের শ্বাস প্রশ্বাসকেও যদি উপলব্ধি করার ইচ্ছে হয় তার জন্যে আছে'অরণ্যসুন্দরী রিসর্ট '। 
    ভাল্কি মাচান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে যমুনা দিঘী,আর এক পর্যটনক্ষেত্র।রাজা মহেন্দ্রনারায়ণ ও তাঁর স্ত্রী অমরাবতীর ছিল এক পুত্র যোগেন্দ্রনাথ এবং দুই কন্যা যমুনাবতী ও শৈবালিনী।রাজা মহেন্দ্র তাঁর স্ত্রী কন্যাদের খুব ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন।স্ত্রী অমরাবতীর নামে তিনি তাঁর রাজধানীর নামকরণ করেছিলেন 'অমরারগড় ',এবং এই অমরারগড় গ্রামের নিকট দুইখানি বড়ো দিঘী খনন করেদিয়ে প্রজাদের কৃষিকার্যের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।প্রজাহিতৈষি মহেন্দ্র নারায়ণ এই দিঘীদুটির নাম দিয়েছিলেন তাঁর দুই কন্যার নামে-যমুনাদিঘী ও শৈবালনী দিঘী যা অপভ্রংশ হয়ে 'শ্যাওলা দিঘী ',বর্তমানে দুটি দিঘীই একত্রে 'যমুনাদিঘী ' নামে পরিচিত।এই দিঘীদুটিকে কেন্দ্রকরে পশ্চিম্বঙ্গ সরকারের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে মৎস্যপালন দপ্তর ও পর্যটন ক্ষেত্র।এখানে গেলে পাবেন হরেক রকমের টাটকা মাছের বিভিন্ন পদ গ্রহণের সুযোগ।
    রাত্রিবাসের জন্য বেছেনিতে পারেন ভাল্কি মাচানের অরণ্যসুন্দরী গেস্ট হাউস,যোগাযোগঃ০৩৪৫২-২০০৬০৪ অথবা যমুনাদিঘী আম্রপালি গেস্ট হাউসেও থাকতে পারেন।কলকাতায় বিকাশ ভবনের স্টেট ফিসারিজ ডেভলপমেন্ট করপোরেশনের অফিস থেকে এখানে থাকার যোগাযোগ করা যায়।হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন নিকটেই দোকরাশিল্পের জন্য বিখ্যাত গ্রাম দরিয়েপুর।

   প্রকৃতির অপরূপত্বের  সুন্দরতম প্রকাশে যুগ যুগান্তর ধরে ধরিত্রীর বুকে ভাল্কি মাচানের এই অরণ্য মানব সভ্যতার সঙ্গে যেন জড়িয়ে রয়েছে গভীর আত্মীয়তার অন্তরঙ্গ বন্ধনে।আধুনিক ব্যস্তময় যন্ত্রসসভ্যতার পাশাপাশি কলকাতার নিকটে পাথুরে লাল মোড়াম মাটির এই দেশে পা ফেলে,বা বনের আরো গভীরে বৃক্ষশাখার পুষ্পসম্ভার,হরিত পর্ণ সম্ভারের দর্শনে,আর ঋতুচক্রের নিজস্ব বৈশিষ্টে অরণ্যসুন্দরীর নৈসর্গিক শোভার নৈকট্যে আমাদের মন  হয়েউঠে মুগ্ধ ও বিহ্বল।ঠিক মতো প্রচারপেলে এই অরণ্য পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে অবশ্যই জায়গা করেনিবে।

পথনির্দেশঃকলকাতা বা বর্ধমান থেকে দুর্গাপুর হাইওয়ে ধরে গলসির পারাজ মোড় থেকে ডানদিকে ২২কিলোমিটার,ট্রেনে বর্ধমান স্টেশন থেকে আসানসোল লোকাল ধরে মানকর স্টেশনে নেমে ১০-১২ কিলোমিটার।
                             ____________________________




No comments:

Post a Comment