Friday, May 1, 2020

ঐতিহ্যবাহী কালিকাপুর ও মৌখিরা
     ফিরোজ আলি কাঞ্চন
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অতীত ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের উদাসীনতা ও অবহেলা দেখে বাঙালীর ইতিহাস নাই বলে আক্ষেপ করেছিলেন,সেই আক্ষেপ আজও যেন আমাদের রয়েগেছে।আমরা রক্ষা করতে পারছিনা ইতিহাসের গন্ধ মাখা আমাদের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন ও স্থান গুলিকে।অথচ আমাদের জেলায় জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতো প্রাচীন রাজবাড়ি,জমিদার বাড়ি,প্রাচীন মন্দির,মসজিদ,দেউল বা আরো প্রাচীন হাজার বছরেরো আগের বিভিন্ন ঢিবি থেকে প্রাপ্ত পোড়া মাটির প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনময় স্থান গুলিকে। এ সবকে কেন্দ্র করে যদি ছোট খাটো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়,তাহলে একদিকে যেমন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে সমৃদ্ধ তেমনি অতীতের ঐতিহ্যগুলিও রক্ষা পাবে।
    সুলতানী ও মুঘলযুগে বিশেষ করে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের সময় বাংলায় বিভন্ন মসজিদ, মক্তব বা পীরের দরগা গড়ে উঠেছিল তেমনি   বিভিন্ন রাজা বা ব্রিটিস যুগে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলায় যে জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল সেই জমিদার ও জমিদারদের ছত্রছায়ায় থাকা দেওয়ান বা পদস্থ কর্মচারীরা গ্রামাঞ্চলে প্রভূত সম্পদের মালিক হয়ে উঠে নির্মান করেছিল বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা ও টেরাকোটার কারুকার্যময় সব অসংখ্য মন্দির।বিশাল সেই অট্টালিকা গুলি জনসাধারনের কাছে জমিদার বাড়ি বা রাজবাড়ি নামে পরিচিত।অখণ্ড বর্ধমান জেলায় এ ধরনের বেশকিছু রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়,যেমন - মূল বর্ধমান শহরে রাজবাড়ি বা রাজবাটি,যেটি এখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী ভবন রুপে ব্যবহৃত। এছাড়াও আমদপুর রাজবাড়ি,কালনা রাজবাড়ি,বড়শূল রাজবাড়ি,কুলগাছি রাজবাড়ি,চকদিঘী রাজবাড়ি, গুস্কারার চোংদার পরিবারের রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ি,পশ্চিম বর্ধমানের শিয়ারশোল রাজবাড়ি,উখড়া রাজবাড়ি,প্রভৃতি।তবে জেলায় যে জমিদার বা রাজবাড়িটির ভগ্নপ্রায় বিশাল কাঠামো পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে সেটি পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রাম অঞ্চলের কালিকাপুর গ্রামের রায়পরিবার নির্মিত জমিদার বাড়িটি।
      বুদবুদ বা মানকর স্টেশন থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর দিকে শাল পিয়ালের বন পথ ধরে গেঁড়াই বিষ্টুপুর পেড়িয়ে শান্ত নিরিবিলি প্রকৃতির মাঝে এক প্রাচীন গ্রাম কালিকাপুর।এখানে আছে প্রায় ৪০০বছরের প্রাচীন জমিদার বাড়ি।বিশাল অট্টালিকার বেশিরভাগটাই ভগ্নপ্রায়,আগাছায় ভর্তি।তবুও শেষ অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রেখে এই জমিদারবাড়িটি আজও খুবই আকর্শনীয়।বিশেষ করে সিনেমা পরিচালকদের কাছে সুটিংকরার আদর্শ স্থান হিসেবে এ জমিদারবাড়িটি খুবই জনপ্রিয়,অসংখ্য বাংলা হিন্দি সিনেমা সিরিয়ালের সুটিং এ খানে হয়েছে; যেগুলির মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের 'নৌকাডুবি',রুদ্রনীল অভিনীত ' এলার চার অধ্যায় ',অর্পনা সেনের ' গয়নার বাক্স 'প্রভৃতি সাহিত্যধর্মী বা অন্যধারার সিনেমা যেমন আছে তেমনি আবার ' ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে ' এর মতো সিনেমাও রয়েছে।আবার বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেন হিন্দি ' খণ্ডহর' ছবির সুটিং এখানে করেছিলেন,যেটিতে অভিনয় করেছিলেন নাসিরউদ্দিন শাহ,পঙ্কজ কাপুরের মতো অভিনেতারা।এক ইতালি তথ্যচিত্রেরও সুটিং এখানে হয়েছিল।
  পার্শ্ববর্তী মৌখিরা গ্রামের পরমান্দ রায় ছিলেন বর্ধমানের মহারাজাদের দেওয়ান।বর্ধমান রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর সম্পর্ক।মহারাজার কাছ থেকে তিনি এই অঞ্চলের জমিদারি লাভ করলেন।তখন এ স্থান ছিল আরো গভীর জজ্ঞল,বন কেটে তিনি বানালেন সাত পুত্রের জন্য সাত মহল জমিদার বাড়ি।মৌখিরা গ্রাম তখন প্রায়ই কুনুর নদীর জল উপছে বন্যায় প্লাবিত হয়ে যেত,তাই তিনি জমিদার বাড়ি বানিয়ে ছিলেন কালিকাপুর গ্রামে।জমিদারবাড়ির প্রবেশ মুখে উত্তর দিকে এক ছোট্ট পুস্করিণী খনন কনন করলেন,আর সম্মুখে নির্মান করলেন দুটি শিব মন্দির।সেকালে এই জমিদার বাড়ি কোলাহলে সর্বদা মুখরিত হয়ে থাকতো।মহাসমারোহে ধূম ধাম করে হতো দুর্গা পুজো,এমনকি বর্ধমানের রাজবাড়ি থেকে কালিকাপুর এই জমিদার বাড়িতে তত্ব পাঠানো হতো।পুজোয় যাত্রা,কবি গানের আসর বসত,হাজার হাজার প্রজাসাধারণকে পাত পেড়ে খাওয়ানো হতো।এখন সে দিন আর নেয়।পুজোর এই বিশাল খরচা বর্তমান প্রজন্মের রায় পরিবারের সদস্যদের পক্ষে স্বাভাবিক ভাবেই বহন করা আর সম্ভবপর হয়ে উঠেনা,কিন্তু এক উপায় তাঁরা খুজে পেয়েছেন।এই জমিদার বাড়িটি এতোই কারুকার্যখচিত যে সারাবছর এখানে সিনেমা সিরিয়ালের কিছুনা কিছু সুটিং যেন লেগেই থাকে,তা থেকে যে সামান্য অর্থ পাওয়াযায় সে অর্থ গচ্চছিত রেখে বছর শেষে পুজোর সময় ব্যয় করা হয়।হয়তো আগের সেই সুদিনের মতো ঘটাকরে আয়োজন আর হয় না,তবুও সেই ধারাকে যথাসাধ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টার ত্রুটি থাকে না,আর এই যুক্তিটা দিয়েছিলেন মৃণালসেন।
     সাতমল জমিদার বাড়ির বেশিরভাগ অংশই এখন ধ্বংসপ্রায়,স্থানে স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে।ঝোপ জজ্ঞল আর আগাছায় ছেয়েগেছে চারিদিক।তবুও বিশাল বিশাল থাম্বা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে,ঝুল বারান্দা,আর অসংখ্য কক্ষ।দেখলেই বোঝাযায় সুপরিকল্পনা,দক্ষ প্রযুক্তিবীদ,নিপুণ কারিগর আর বিপুল অর্থ খরচ করে জমিদার মহাশয় এই মহল গুলি নির্মান করেছিলেন।এক মহলের দোতলায় সারি সারি একাধিক জানালা,এক জানালায় আবার দেখাযায় এক কপাট ফাঁক করে যেন উঁকি দিচ্ছে এক নারী,যেন  অন্দরমহলের আড়াল থেকে দেখে নিচ্ছেন বাইরের কিছু,অথবা কারোর অপেক্ষায়।আসলে এটা এক মূর্তি।সেদিন থেকে আজো শত শত বছর ধরে বিরামহীন এই প্রতীক্ষা! এই জমিদার বাড়ির কতো জন্ম-মৃত্যু,হাসি-কান্না,আনন্দ-বেদনা,উত্থান-পতনের নীরব সাক্ষী যেন এই নারী।

    প্রাচীন এই জমিদার বাড়িটি নিজস্ব বৈচিত্র,বৈশিষ্ট ও স্বীকতায় এতোটাই ব্যতিক্রমী যে তা দর্শনে আমাদের চেতনাকে উদ্বেল করে তুলে।এককালে এই মহলের প্রতিটি কক্ষ,বারান্দা জমিদার পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি,অসংখ্য চাকর বাকরদের হট্টগোল,পাইক প্রহরী,গোমস্তা কর্মচারীদের কলরবে সর্বদা মুখোরিত হয়ে থাকতো।সেদিন আজ অতীত,কালের নিয়মে হতাশার অন্ধকারে মুখথুবড়ে পড়েথেকে এই সাতমহল জমিদারবাড়ি শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্বটুকু টিকেয়েরেখেছে যেন।
       রায়পরিবারের আদি নিবাস মৌখিরা গ্রামও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধময়।প্রচলিত আছে মধুময় ক্ষীরের মত ছিল এখানের আমের স্বাদ, তাই গ্রামের নাম হয়েছে ' মৌখিরা '।গ্রামটির বিশেষত্ব হলো,এখানে রয়েছে বেশকিছু  প্রাচীন মন্দির,যেগুলি অপূর্বসব টেরাকোটার কারুকার্যও নান্দনিক সৌন্দর্যে খুবই দৃষ্টিনন্দন।এছাড়াও আছে  ১৭৬১ শকাব্দে নির্মিত এক বিশাল প্রাসাদ প্রতিম দুর্গাবাড়ি।
      মৌখিরাগ্রামে প্রাচীন মন্দিরের সংখ্যা মোট ১২টি।গ্রামে প্রবেশ করেই প্রথমে চোখে পড়বে সুপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত ডান দিকে ও বাম দিকে কিছু সারিবদ্ধ মন্দির।মাঝে সরু পথের শেষ প্রান্তে আর এক মন্দির।ডান দিকের মন্দির গুলি পশ্চিম মুখি ও বাম দিকের মন্দির গুলি পূর্ব মুখি।ডান দিকে একই ভিত্তিবেদির উপর মন্দির তিনটি দেউল রীতিতে নির্মিত, বাম দিকেও মন্দির সংখ্যা তিনটি;যার মধ্যে দুটি দুটি দেউল রীতিতে নির্মিত পূর্ব মুখি ও একটি আটচালা রীতিতে নির্মিত উত্তর মুখি।সবকটি মন্দিরই শিব ঠাকুরের।এইসব মন্দিরগুলিতে খিলানের উপর অংকিত অলংকরনে আছে  বিভিন্নধরনের  মোটিফ-রাধাকৃষ্ণ,শিব,পার্বতি,কালী,বাদ্যবাদক,ফুল,লতাপাতা,পাখি প্রভৃতি। গবেষকগণ এই বৈচিত্রকে পৌরাণিক,সামাজিক ও প্রাকৃতিক মোটিফে বিভক্ত করেছেন।একেবারে সামনে আছে একটি দক্ষিণমুখি আটচালা রীতিতে নির্মিত শিবমন্দির।এই মন্দিরটির সামান্য ডানদিকে রায়বাড়ির নিকট দেখাযাবে এক পঞ্চচূড়া রীতিতে নির্মিত লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির।এই মন্দিরটিই এখানের সবচেয়ে বড়ো ও আকর্ষনীয়,এটির টেরাকোটার কারুকার্যও অধিক।অলংকরণে শিল্পীর নিপুণ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়, চতুর্ভুজ শ্রীকৃষ্ণের জন্মকথা,বাল্যলীলা প্রভৃতি কাহিনী প্রকাশিত।দুঃখের বিষয় ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের বন্যায় এই মন্দিরগুলি ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং টেরাকোটার অনেক কারুকার্য নষ্ট হয়।
    মৌখিরাগ্রামের এই মন্দিরগুলি যে সব একই সময়ে নির্মিত হয়েছিল তা নয়।দক্ষিণমুখি আটচালা রীতিতে নির্মিত শিব মন্দিরটিতে টেরাকোটার ফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে ১৭১৫ শকাব্দ,১২০০ সন।আঞ্চলিক গবষকদের অনুমান  এটি এই মন্দরের নির্মানকাল,পরবর্তীতে বা পূর্ববর্তীতে রায় পরিবারের বিভিন্ন সদস্যগণ অনান্য মন্দিরগুলি বিভিন্নকালে নির্মিত করেছিলেন।
  মৌখিরা গ্রামের পাচীন কারুকার্যখচিত মন্দির,দুর্গাবাড়ি ও কালিকাপুরের সাতমহল জমিদারবাড়ি প্রমাণকরে রায় পরিবারের প্রতিপত্তি,আর্থিক ক্ষমতা,ধর্মপরায়নতা ও সৌন্দর্য বোধের।







       উপরের ছবি গুলি মৌখিরা গ্রামের অপূর্ব মন্দির গুলির

      নীচের ছবিগুলি কালিকাপুর      জমিদারবাড়ির












বিঃদ্রঃ
প্রবন্ধটি আনন্দবাজার পত্রিকার বর্ধমান জেলার পৃষ্ঠায়প্রকাশিত।অন্যকোথাও এ প্রবন্ধ ও ছবি প্রকাশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেয়ার করতে পারেন
  

No comments:

Post a Comment