জানেন কি বাংলার কোন স্কুল রবিবারও খোলা থাকে?
স্বদেশ প্রেম আর ব্রিটিশ বিরোধীতার আদর্শ অনুসরন করে আজো রবিবার ক্লাসচালু থাকে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে।
বর্ধমান-হাওড়া কর্ড লাইনের উপর জৌগ্রাম স্টেশন থেকে উত্তরে আমড়া মোড়,নূড়ির মোড় ধরে দুই থেকে তিন কিলোমিটার গেলেই মেমারী রোড়ের ধারে অবস্থিত এলাকার সুপ্রাচীন এক শিক্ষ্যা প্রতিষ্ঠান_ গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়।বিদ্যালয়টির গঠন-পঠন-পাঠন সব দিক থেকে অনান্য বিদ্যালয় গুলির মতোই স্বাভাবিক,কিন্তু নিজস্ব বিশেষ এক বৈশিষ্ট্যে এই বিদ্যালয় যেন সারা দেশে এক ব্যতিক্রমী নজিড় সৃষ্টি করেছে।ব্রিটিশ সরকার এখন আর এ দেশে না থাকলেও তাদের চালু করা প্রথা অনুসরন করে আজো আমাদের দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রবিবার বন্ধ রাখা হয়,কিন্তু গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে আজো রবিবার ক্লাস চালু থাকে,যা এই প্রথাগত ধারনার বাইরে থেকে এই বিদ্যালয় কে একটা আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।অবশ্য এর প্রেক্ষাপটে রয়েছে স্বদেশ প্রেম আর তীব্র ব্রিটিশ বিরোধীতের ঐতিহ্যের ধারা।
ভারতবর্ষ তখন পরাধীন।১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে জাতীয় ক ংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব পেশ করেন।এই অসহযোগ আন্দোলনের ইতিবাচক বা গঠনমূলক কর্মসূচিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন। দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করলেন,"শিক্ষা অপেক্ষা করতে পারে কিন্তু স্বরাজের আর অপেক্ষার সময় নেই।"দলে দলে শিক্ষকেরা পদত্যাগ করতে লাগলেন,সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি থেকে দিনের দিন ছাত্রের সংখ্যা কমে যেতে লাগলো।
অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার তখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।আর এই আন্দোলন কে সফল করে তুলতে নিজের নিজের সাধ্যমত আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আপামর বাঙালি। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বধ'মান জৌগ্রামের নিকট প্রতিষ্ঠিত হয় গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়।স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রধান উদ্যোগী ছিলেন অবিনাশচন্দ্র হালদার মহাশয়,তিনি নিজের দান করা জমিতে প্রথমে যখন বিদ্যাল য় প্রতিষ্ঠা ক রেন তখন ছিল খড়ের এক টি আটচালা।গোপালপুর গ্রাম বাসীর আরাধ্যদেবতা মা মুক্তকেশীর নাম অনুসারে বিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় 'গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় '। অবিনাশচন্দ্র হালদারের সজ্ঞে সহযোগীতায় ছিলেন বিজয় কৃষ্ণকুমার,রাজবল্লভ কুমার,ভূষণ চন্দ্র হালদার প্রমুখগণ।
বিদ্যালয়ের সহঃ শিক্ষক নাজিবর রহমান জানালেন, "বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম রেজোলিউশনে কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ব্রিটিশ বিরোধীতার তীব্র প্রমান রুপে রবিবার বিদ্যালয়ের পঠন পাঠন চালু থাকবে সেই ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে আজো আমাদের বিদ্যালয় রবিবার খোলাথাকে,এবং রবিবারের পরিবতে' সোমবার ছুটি থাকে।"
বিদ্যালয়ের আরো কিছু সহঃ শিক্ষক পূণ'চন্দ্র মাজি,রাজীব রাহা,দেবব্রত রায়,লাল্টু কোলে,সৌরভ সরকার,ও সহঃ শিক্ষিকা তাঞ্জিলা খাতুনেরা জানালেন, "তখন বাংলার সমস্ত স্কুলকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিনিতে হতো,কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ছিল ইংরাজী ভাষা ও ব্রিটিশ বিরোধীতাকরে প্রতিষ্ঠিত সম্পূণ' বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়।কিন্তু এটা ব্রিটিশ সরকার মেনে নিতে পারলোনা,ফলে আমাদের বিদ্যালয়কে স্বীকৃতি দিল না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।এমন এক ঐতিহ্যময় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আমরা সত্যি গবি'ত।
গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় শুধু তার ঐতিহ্যকে টিকিয়েই রাখেনি,চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে চাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সামাজিক জ্ঞান ও দায়ীত্ববোধের সঞ্চার ঘটিয়ে এবং প্রথাগত শিক্ষযগত যোগ্যতার উচ্চসীমায় পৌছে দেওয়ার মহান ব্রত আজো সে দায়ীত্ব সহ কারে পালন করে যাচ্ছে।বর্তমানে এখানে কারগরি শিক্ষারও ব্যবস্থা চালু হয়েছে।এই বিদ্যালয়ের অসংখ্য প্রাত্তন ছাত্র ছাত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত,সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এই বিদ্যালয়েরই প্রাত্তন ছাত্র ছিলেন।
শত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে এই বিদ্যালয় আজো তার ধারাকে অব্যাহত রাখতে পেরেছে।১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরাজী পড়াবার অনুম তি পায়,এবং ১৯৬৪খ্রিষ্টাব্দেউচ্চ মাধ্যমিক স্তরেউন্নিত এই বিদ্যালয়ের চাত্র ছাত্রীর স ংখ্যা বত'মানে প্রায় তেরোশো।এক কথায় নিজস্ব ঐতিহ্যের ধারাকে আজো বজায়রেখে গোপাল পুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় শুধু বাংলায় নয় ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলির মধ্যে একটা নিজস্ব পরিচিতি লাভ করেছে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়।
লেখা ও ছবি ঃফিরোজ আলি কাঞ্চন
বিঃদ্রঃ লেখাটি এই সময় পত্রিকার বর্ধমান সমাচার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত,এখানে কিছুটা পরিবর্তিত।এই লেখা ও ছবি কপি করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেয়ার করতে পারেন।