Tuesday, September 10, 2019


      গড়ের  ঢিবি, তালিতের পীর হজরত মুশা ও বর্ধমানে বর্গী
        
         (একটি ক্ষেত্র সমীক্ষা)


রাঢ় বঙ্গের মধ্যমণী বর্ধমান জেলা এক প্রাচীণ জনপদ।জৈন আচারঙ্গ সূত্রে 'সুহ্মভূমি ',বাঁশঘেরার হর্ষবর্ধনের লিপিতে ' বর্ধমানকোটি ',গলসি অঞ্চলের মল্লসারুল গ্রামে জারুল নামক এক পুকুরে পঙ্ক উদ্ধারের সময় পাওয়া বঙ্গদেশের প্রাচীনতম তাম্রপট্ট লিপিতে ' বর্ধমানভুক্তি ' সহ বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বর্ধমানের উল্লেখ পাওয়া যায়।বর্ধমান জেলার ঐতিহ্যেএকদিকে যেমন আছে রাঢ় বঙ্গীয় বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি ও লোক বিশ্বাসের বিভিন্ন উপাদান,তেমনি আবার সেই প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী বর্ধমান জেলার মাটি।এখানের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান ঢিবি গুলি থেকে আবিস্কৃত নিদর্শন গুলি যেমন জেলার প্রত্ন তাত্বিক ঐতিহ্যর গুরুত্বকে প্রমাণিত করে তেমনি আবার বিভিন্ন স্থানের একাধিক ' গড়  'গুলি গড়েউঠার নেপথ্যেও রয়েছে  ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ।

বর্ধমান নবাবহাটের নিকট গ্রাম গড় বা গড় তালিত।গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে শান্ত নিরিবিলি নির্জন এক স্থানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রয়েছে অনেকগুলি ছোট ছোট ঢিবি।নিদৃষ্ট দূরত্বে গোলাকার ভাবে ঢিবি গুলি উঁচু বাঁধ দিয়ে পরস্পর  সংযুক্ত।বাঁধের বাইরের দিকে আবার পরিখা খনন করা,আকাশ পথ থেকে দেখলে অনেকটা ঘোড়ার নালের মতো,অপূর্ব তার সৌন্দর্য। একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই অনুমেয় শত্রু বাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই এমন নিরাপত্তা বেষ্টনীর নির্মাণ।
         উদাশীনতা আর অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে ঢিবি গুলি,ঢিবি ও বাঁধ কেটে চাষের জমিতে পরিণত হচ্ছে,পরিখা গুলিও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে বাঁধদিয়ে ছোট ছোট পুকুর এখন; তবুও নীরবে ঐতিহ্য আর বর্ধমানের ইতিহাসের মূক সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে রয়েছে তালিত গড়ের বেশ কয়েকটি ঢিবি।
          তালিত গড়ে ঢিবির সংখ্যা ছিল মোট ষোল টি,প্রত্যেক ঢিবিতে ছিল একটি করে কামান,কামান গুলিতে পারসি ভাষায় খোদিত ছিল বর্ধমানরাজ চিত্র সেনের নাম।চিত্রসেন নির্মিত আরো এমন একাধিক ঢিবির সন্ধান পাওয়া যায় রাজগড়, পানাগড়,সেন পাহাড়ী,এবং কাউগাছি বা কোগাছিতে।কাহিনীর অতীত সূত্রধরে এ প্রসজ্ঞে একের পর এক চলে আসে বর্ধমানে বর্গী আক্রমণ, চিত্রসেনের গড় নির্মান ও ভীত হয়ে আগেথেকেই বর্ধমান ছেড়ে পলায়ণ,নবাব আলীবর্দি খাঁ য়ের বর্ধমান আগমণ ও নবাব বেগম কে বর্গীদের অপহরণ,সেই সূত্রে নবাব বেগমকে  উদ্ধার করতে গিয়ে তালিতের পীর হজরত মুসার আত্মবিসর্জনের ঘটনা গুলি। 

১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে কীর্তিচাঁদের মৃত্যু পর তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী চিত্রসেন রায় বর্ধমানের জমিদারী লাভ করলেন,উল্লেখ্য এই চিত্রসেনই সর্ব প্রথম  দিল্লীর মুঘল সম্রাটের নিকট হতে ' রাজা ' উপাধির অধিকারী হয়ে চাকলে বর্ধমান সরকার সলিমাবাদের সত্বাধিকারী প্রাপ্ত হন এবং নাজরানা আদায় করার অনুমতি পান।মাত্র চার বছর রাজত্ব কালে চিত্রসেনকে মোকাবিলা করতে হয়েছি বাংলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখাত ভয়ংকর বর্গী বাহিনীকে।সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার রচিত ' চিত্রচম্পু ' কাব্যে চিত্রসেনের চরিত কথার বর্ণনা পাওয়া যায়।
    সম্রাট মহম্মদ শাহের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব বাংলায় বর্গী আক্রমণের মূল কারণ,আলিবর্দি  খাঁকে একদিকে যেমন তিনি সুবে বাংলার সুবাদারী প্রদান করেছিলেন,আবার অন্যদিকে বালাজিরাওকে চৌথ আদায়ের দায়ীত্ব দিয়েছিলেন।ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আলিবর্দি খায়ের সঙ্গে মারাঠাদের বিরোধ অনিবার্য হয়েউঠে।আর এই বিরোধে বর্গীদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েউঠে সমগ্র বর্ধমান জেলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা।গঙ্গারাম রচিত মহারাষ্ট্র পুরাণ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গের বর্ণনায় পাওয়াযায়-' তবে সব বরগি গ্রাম লুটিতে লাগিল/জত গ্রামের লোক সব পালাইল।/ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পলায় পুঁথির ভার লইয়া/সোনার বাইনা পলায় কত নিক্তি হুড়পি লইয়া।/গন্ধ বণিক পলায় দোকান লইয়া জত/তামা পিতল লইয়া কাঁসারি পলায় কত।/শঙ্খ বণিক পলায় কয়াত লইয়া জত/চতুর্দিকে লোক পলায় কি বলিব কত।'
   ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাস, ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে কুড়িহাজার মারাঠা সৈন্য নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে বর্ধমানের অভিমুখে যাত্রা করে।চিত্রসেন আগেথেকেই তা অনুমান করেছিলেন,তাই বর্ধমানের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে রাজবাড়ির নিকটে তালিত গড়ও কাটিয়ে রেখেছিলেন।কিন্তু বর্গী দস্যুদের ক্ষীপ্রতা আর অত্যাচারের কাহিনী তিনি অবগত ছিলেন,তাই সাহসে কুলালো না,তিনি পরিবার ও বিশ্বস্ত মন্ত্রী মানিকচাঁদকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন মুর্শিদাবাদে।
           এদিকে আবার নবাব আলীবর্দি খাঁ উড়িষ্যার বিদ্রোহ দমন করে ফিরে আসার পথে বর্ধমানে পৌঁছে রাণিসায়েরের পাড়ে শিবির ফেললেন।কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রবেশ করে দস্যু বর্গী বাহিনী ১৫ এপ্রিল একেবারে নবাবের সৈন্যদের উপর হামলা চালায়।এতে নবাবের তাবু পর্যন্ত বর্গীরা পৌছাতে পারেনা ঠিকই তবে নবাবের সৈন্যদের অবরুদ্ধ করে রাখে।ভাস্কর পণ্ডিত বর্ধমান রাজের প্রাসাদতূল্য রাজবাড়ি দখল করে সেখানে অবস্থান করে পার্শবর্তী স্থান গুলিতে ব্যাপক লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, খুন,রাহাজানি চালাতে থাকলো;সেই সাথে নবাবের সৈন্যদের বাইরেথেকে সমস্ত রকম খাদ্য সরাবরাহ ও যোগাযোগ বন্ধ করে রাখলো।গবেষকদেঁর তথ্য মতে সে সময় নবাবের সৈন্যদলকে সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর পর তিন দিন অভুক্ত অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল।অবস্থা বেগতিক দেখে নবাব নিজের সৈন্যদের অর্থ পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়ে উৎসাহিত করে মরিয়া হয়ে রণ সাজে সজ্জিত হয়ে বর্গীদের অবরোধ ভেদ করে ২২ এপ্রিল কাটোয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
         নবাবের সফর সঙ্গী ছিলেন বেগম শরফুন্নেশা।আলীবর্দি বেগম সহ মহিলাদের বর্ধমানে থেকেযেতে অনুরোধ করলেন,কিন্তু বর্গীদের ভয়ে কেউই থাকতে রাজি হলেন না।নবাবের সৈন্যদল বেগম শরফুন্নেসাকে ' লণ্ডা ' নামের এক হস্তিনীর পিঠে চড়িয়ে নিরাপত্তায় ঘিরে নিয়ে যেতে থাকলেন।কিন্তু সেদিন আকাশের মুখ ছিল ভার,তুমুল বৃষ্টিপাতের জন্য নবাবের সৈন্যরা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়লেন,আর তা বর্গী দস্যুদের যেন বাড়তি সুবিধা এনে দিল।তখন গলসির সাটিনন্দী গ্রামের নিকট ফাঁকা মাঠে শিবির গড়েছিল বর্গীরা।তালিত গ্রামের নিকট নবাবের সৈন্য পৌঁছালে অতর্কিত আক্রমনে নবাব সৈন্যরা পিছু হটে,আবার বর্ধমানে ফিরে আসার পথও বর্গীরা বন্ধ করে দিল;শুধু তাই নয়,নবাব সৈন্যদের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে বেগম কে বন্দী করে ফেলতে উদ্যত হয়।
    কাহিনীর এই ঘটনাক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিতে উপস্থিত হন তালিত রেলগেট পার হয়ে শিউড়ি রোডের ধারে আলমপুর গ্রামের নিকট যে প্রাচীন পীরের মাজার আজও এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় পীরের মাজার সেই হজরত মুশাপীর। হজরত মুশা ছিলেন নবাবের সেনাধ্যক্ষ উমর খানের পুত্র,প্রকৃত নাম মুশাহেব খান।মুশাহেব খান শুধু একজন যোদ্ধাই ছিলেন না,তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক জগতের ব্যক্তি।দুর্বল এক নারী অপহৃত হতে যাচ্ছে দেখে তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না,বীর বিক্রমে অস্ত্রহস্তে যুদ্ধ করে তিনি দস্যু বর্গী সেনাদের ছত্র ভঙ্গ করে ফেললেন,নবাব বেগমকে উদ্ধার করলেন।কিন্তু তালিতের সেই যুদ্ধে মুশাহেব খান বরণ করলেন শহীদের মৃত্যু।
             মুশাহেব খানের আধ্যাত্মীক জ্ঞান ও আত্মবিসর্জনের মাহাত্ম স্থানীয় জনমানসে তাঁকে পীরের মর্যাদা দিয়েছে।প্রতি বছর ২১ শে পৌষ এই মুশাপীরের উরস উপলক্ষে এক বিরাট মেলা বসে,হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলের কাছে তাঁর মাজার পবিত্রতা ও শ্রদ্ধার স্থান। এই পীর সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে অনেক কেরামতি বা অলৌকিক ঘটনার কাহিনী।জনশ্রুতি তালিতের যুদ্ধে বর্গীদের সাথে যুদ্ধে মুশাহেব খানের দেহ থেকে মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন হয়েগিয়েছিল,শিউড়ি রোডের ধারে যেখানে বর্তমান মাজার অবস্থিত তার বিপরীত দিকে মাঠে যুদ্ধস্থলে আরো অনেক সৈনিকের মুণ্ডুবিহীন দেহের সাথে মুসাহেব খানের ক্ষত বিক্ষত দেহও পড়েছিল;কিন্তু কোন দেহটা মুসাহেব খানের তা চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছিল না।এ দিবে নবাব আলীবর্দি বিশ্বস্ত এই সৈন্যের দেহ যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করতে না পড়ায় বিচলিত হয়ে পড়লেন,রাত্রে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যুদ্ধক্ষেত্রে পড়েথাকা অসংখ্য মুণ্ডুহীন দেহের মধ্যে এক দেহের উপর ফুল দেওয়া,সঙ্গে সঙ্গে রাত্রিতেই তিনি ঘুম থেকে উঠে অনুচরদের সাথে নিয়ে পৌছালেন যুদ্ধের মাঠে,দেখলেন সত্যিই তাই,এক মুণ্ডুহীন দেহের উপর ফুল রাখা।মুশাপীরের পবিত্র দেহ নবাব আলীবর্দির তত্তাবধানে সমাধিস্ত করা হলো।
             কিন্তু দুঃখের বিষয় কালের নিয়মে যেন হাড়িয়ে যেতে বসেছে বর্ধমানের অতীত ইতিহাসের গৌরবময় এই অধ্যায় গুলি।যে কটি গড়ের ঢিবি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই তার মাটি কেটে সমতল করেনিয়ে অচিরেই চাষ যোগ্য জমিতে পরিণত হবে।আমরা জানিনা তালিত গড়ের ইতিহাস,রাজা চিত্রসেনের অসহায়তার কথা,বর্ধমানের তৎকালী প্রজা সাধারণের প্রতি বর্গী দস্যুদের অত্যাচারের করুণ কাহিণী বা পীর হজরত মুশার প্রকৃত মাহাত্ম!হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর জানতেই পারবেনা এগুলির ঐতিহ্যকে।সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই জন্যই বাঙালীর ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন,সে আক্ষেপ আজো যেন আমাদের রইয়ে গেছে।
         ----------

তালত গড়ের ঢিবি
গড়ের প্রবেশপথ,নিশ্চিহ্ন হওয়ার অপেক্ষায়


হজরত মুশাপীরের মাজারের প্রবেশপথ
মুশাপীরের মূল মাজার
নবাবহাট থেকে উত্তরে শিউড়ি রোডের ধারে আলমপুরের নিকট হজরত মুশাপীরের মাজার

মাজারের পশ্চিমদিকে রাস্তার ওপাড়ে এই মাঠেই যুদ্ধে হজরত মুশাপীর শহীদ হয়েছিলেন,শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুণ্ডু এখানেই পায়াগিয়েছিল বলে শুনলাম,স্থানটি ভক্তদের কাছে শ্রদ্ধার।

বিঃদ্রঃ এই মাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রাম জনুড়া আমার মামার বাড়ি,ছোট থেকেই নানি ও মায়ের সাথে এই মাজারে অনেকবার এসেছি,আজ এই মাজারের মাহাত্ম আমার কাছে যেন নতুন ভাবে উন্মোচিত হলো।
ফিরোজ আলি কাঞ্চন
(এই লেখা ও ছবি অন্যকোথাও প্রকাশ বা কপি করা নিষিদ্ধ, সেয়ার করতে পারেন) 

No comments:

Post a Comment