Saturday, September 28, 2019

      তকীপুরের বড় কালী
 








' ঠাকুর আর পুকুর/এই নিয়ে তকীপুর। ' বর্ধমান জেলার শক্তিসাধনায় আউসগ্রাম থানা অঞ্চলের  প্রাচীন জনপদ তকীপুর গ্রাম এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।বহু পূর্বে এই স্থান ছিল ঘন বেত বনের গভীর জজ্ঞল,আর সে জজ্ঞল ছিল ঠ্যাঙারে ডাকাতদের অবাধ বিচরনক্ষেত্র।গ্রামের উত্তর প্রান্তে যে মহাশ্মশান ছিল,সেখানে ডাকাতের দল ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে গভীর রাতে মশাল জ্বালিয়ে এসে কালীর সাধনা করে তবে ডাকাতি করতে যেত।সে প্রায় ৬০০ বছর আগের কথা।পরে বর্ধমান মহারাজের উদ্যোগে নির্মিতি হয় বর্তমান মন্দিরটি।
         মন্দিরে নিত্য পূজা দেওয়া হয়,তবে প্রতি সপ্তাহে শনি ও মজ্ঞলবার দেবীর বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।কালীপূজার সময় দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরী করা প্রায় ১৫-২০ফুট উচ্চতার।এই সময় দেবীর পূজার কিছু ব্যতিক্রমী রীতি চোখে পড়ে,মাঝ রাত্রিতে পুরোহিত দেবীর চক্ষুদান করে থাকেন,চক্ষুদান করার পরেই তিনি সোজা বাড়ি ফিরে যান,তখন মশাল জ্বালিয়ে পুরোহিত মশায়কে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসা হয়।আমাবস্যার ভোর বেলায় দেবীর ঘট আনা হয়,তার পর দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।বলিদান দেওয়া হয় সকালে,হোম হয়,প্রতিদিন নিয়ম মেনে ঘট আনা হয়,আবার পুজোর পর সে ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। এই ভাবে  পঞ্চমী পর্যন্ত পূজা চলে।এ প্রসজ্ঞে উল্লেখ্য দেবীর নিজস্ব কম-বেশী  প্রায় ২৭-২৮ ভরি রুপো এবং ৭-৮ভরি সোনার গহনা আছে।এই গহনা পূজা কমিটির মধ্যস্থতায় সারা বছর ব্যাংকের লকারে গচ্ছিত থাকে,পূজার সময় লকার থেকে বেড়করে এনে স্যাকারার কাছে নিয়ে গিয়ে পালিশ করে এনে দেবীকে পরানো হয়ে থাকে,পূজার পর আবার তা নিরাপদে ব্যাংকের লকারে রেখে আসা হয়।
          মন্দিরে বলিদানের প্রথা খুব প্রাচীন।।শোনাযায় সেই ডাকারদের আমলে নাকি এই দেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়া হতো।পরে শুকরও বলি দেওয়ার চল ছিল,তবে তা এখন হয় না।বর্তমানে মোষ,পাঠা,ভেড়া বলি দেওয়া হয়ে থাকে।এই বলির সময় হাজার হাজার ভক্তের সমাগমে মন্দির প্রাজ্ঞন মুখরিত হয়ে থাকে।
              এই দেবী বড়ো জাগ্রত।দেবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে তকীপুর গ্রামবাসীর মধ্যে কিছু প্রথার প্রচলন আছে,যেমন ' নুন পালা 'প্রথা;এই প্রথার নিয়ম অনুযায়ী কোন এক বিশেষ দিনে গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে সেদিন নুন ছাড়া রান্না করা হয়ে থাকে।
             এই বড় কালীর পূজা উপলক্ষে এক বিরাট মেলা বসে।তকিপুর সংলগ্ন ভোতা,বিল্বগ্রাম,সর,দিগনগর,বাহিরঘন্না,আসকরন,কুরকুবা,গলসী,খেতুড়া,বাবলা,বৈচি প্রভৃতি গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হন। বাড়িতে বাড়িতে কুটুম আসে।তকীপুর  গ্রামের বহু পরিবার কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন,এই পূজার কটাদিন দেবীর টানে সেই পরিবার গুলোও যেন গ্রামের মাটিতে ফিরে আসেন।হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তকীপুরের কালীপুজোর মেলা এই অঞ্চলের সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয়।


Tuesday, September 10, 2019


      গড়ের  ঢিবি, তালিতের পীর হজরত মুশা ও বর্ধমানে বর্গী
        
         (একটি ক্ষেত্র সমীক্ষা)


রাঢ় বঙ্গের মধ্যমণী বর্ধমান জেলা এক প্রাচীণ জনপদ।জৈন আচারঙ্গ সূত্রে 'সুহ্মভূমি ',বাঁশঘেরার হর্ষবর্ধনের লিপিতে ' বর্ধমানকোটি ',গলসি অঞ্চলের মল্লসারুল গ্রামে জারুল নামক এক পুকুরে পঙ্ক উদ্ধারের সময় পাওয়া বঙ্গদেশের প্রাচীনতম তাম্রপট্ট লিপিতে ' বর্ধমানভুক্তি ' সহ বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বর্ধমানের উল্লেখ পাওয়া যায়।বর্ধমান জেলার ঐতিহ্যেএকদিকে যেমন আছে রাঢ় বঙ্গীয় বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি ও লোক বিশ্বাসের বিভিন্ন উপাদান,তেমনি আবার সেই প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী বর্ধমান জেলার মাটি।এখানের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান ঢিবি গুলি থেকে আবিস্কৃত নিদর্শন গুলি যেমন জেলার প্রত্ন তাত্বিক ঐতিহ্যর গুরুত্বকে প্রমাণিত করে তেমনি আবার বিভিন্ন স্থানের একাধিক ' গড়  'গুলি গড়েউঠার নেপথ্যেও রয়েছে  ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ।

বর্ধমান নবাবহাটের নিকট গ্রাম গড় বা গড় তালিত।গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে শান্ত নিরিবিলি নির্জন এক স্থানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রয়েছে অনেকগুলি ছোট ছোট ঢিবি।নিদৃষ্ট দূরত্বে গোলাকার ভাবে ঢিবি গুলি উঁচু বাঁধ দিয়ে পরস্পর  সংযুক্ত।বাঁধের বাইরের দিকে আবার পরিখা খনন করা,আকাশ পথ থেকে দেখলে অনেকটা ঘোড়ার নালের মতো,অপূর্ব তার সৌন্দর্য। একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই অনুমেয় শত্রু বাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই এমন নিরাপত্তা বেষ্টনীর নির্মাণ।
         উদাশীনতা আর অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে ঢিবি গুলি,ঢিবি ও বাঁধ কেটে চাষের জমিতে পরিণত হচ্ছে,পরিখা গুলিও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে বাঁধদিয়ে ছোট ছোট পুকুর এখন; তবুও নীরবে ঐতিহ্য আর বর্ধমানের ইতিহাসের মূক সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে রয়েছে তালিত গড়ের বেশ কয়েকটি ঢিবি।
          তালিত গড়ে ঢিবির সংখ্যা ছিল মোট ষোল টি,প্রত্যেক ঢিবিতে ছিল একটি করে কামান,কামান গুলিতে পারসি ভাষায় খোদিত ছিল বর্ধমানরাজ চিত্র সেনের নাম।চিত্রসেন নির্মিত আরো এমন একাধিক ঢিবির সন্ধান পাওয়া যায় রাজগড়, পানাগড়,সেন পাহাড়ী,এবং কাউগাছি বা কোগাছিতে।কাহিনীর অতীত সূত্রধরে এ প্রসজ্ঞে একের পর এক চলে আসে বর্ধমানে বর্গী আক্রমণ, চিত্রসেনের গড় নির্মান ও ভীত হয়ে আগেথেকেই বর্ধমান ছেড়ে পলায়ণ,নবাব আলীবর্দি খাঁ য়ের বর্ধমান আগমণ ও নবাব বেগম কে বর্গীদের অপহরণ,সেই সূত্রে নবাব বেগমকে  উদ্ধার করতে গিয়ে তালিতের পীর হজরত মুসার আত্মবিসর্জনের ঘটনা গুলি। 

১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে কীর্তিচাঁদের মৃত্যু পর তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী চিত্রসেন রায় বর্ধমানের জমিদারী লাভ করলেন,উল্লেখ্য এই চিত্রসেনই সর্ব প্রথম  দিল্লীর মুঘল সম্রাটের নিকট হতে ' রাজা ' উপাধির অধিকারী হয়ে চাকলে বর্ধমান সরকার সলিমাবাদের সত্বাধিকারী প্রাপ্ত হন এবং নাজরানা আদায় করার অনুমতি পান।মাত্র চার বছর রাজত্ব কালে চিত্রসেনকে মোকাবিলা করতে হয়েছি বাংলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখাত ভয়ংকর বর্গী বাহিনীকে।সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার রচিত ' চিত্রচম্পু ' কাব্যে চিত্রসেনের চরিত কথার বর্ণনা পাওয়া যায়।
    সম্রাট মহম্মদ শাহের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব বাংলায় বর্গী আক্রমণের মূল কারণ,আলিবর্দি  খাঁকে একদিকে যেমন তিনি সুবে বাংলার সুবাদারী প্রদান করেছিলেন,আবার অন্যদিকে বালাজিরাওকে চৌথ আদায়ের দায়ীত্ব দিয়েছিলেন।ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আলিবর্দি খায়ের সঙ্গে মারাঠাদের বিরোধ অনিবার্য হয়েউঠে।আর এই বিরোধে বর্গীদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েউঠে সমগ্র বর্ধমান জেলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা।গঙ্গারাম রচিত মহারাষ্ট্র পুরাণ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গের বর্ণনায় পাওয়াযায়-' তবে সব বরগি গ্রাম লুটিতে লাগিল/জত গ্রামের লোক সব পালাইল।/ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পলায় পুঁথির ভার লইয়া/সোনার বাইনা পলায় কত নিক্তি হুড়পি লইয়া।/গন্ধ বণিক পলায় দোকান লইয়া জত/তামা পিতল লইয়া কাঁসারি পলায় কত।/শঙ্খ বণিক পলায় কয়াত লইয়া জত/চতুর্দিকে লোক পলায় কি বলিব কত।'
   ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাস, ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে কুড়িহাজার মারাঠা সৈন্য নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে বর্ধমানের অভিমুখে যাত্রা করে।চিত্রসেন আগেথেকেই তা অনুমান করেছিলেন,তাই বর্ধমানের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে রাজবাড়ির নিকটে তালিত গড়ও কাটিয়ে রেখেছিলেন।কিন্তু বর্গী দস্যুদের ক্ষীপ্রতা আর অত্যাচারের কাহিনী তিনি অবগত ছিলেন,তাই সাহসে কুলালো না,তিনি পরিবার ও বিশ্বস্ত মন্ত্রী মানিকচাঁদকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন মুর্শিদাবাদে।
           এদিকে আবার নবাব আলীবর্দি খাঁ উড়িষ্যার বিদ্রোহ দমন করে ফিরে আসার পথে বর্ধমানে পৌঁছে রাণিসায়েরের পাড়ে শিবির ফেললেন।কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রবেশ করে দস্যু বর্গী বাহিনী ১৫ এপ্রিল একেবারে নবাবের সৈন্যদের উপর হামলা চালায়।এতে নবাবের তাবু পর্যন্ত বর্গীরা পৌছাতে পারেনা ঠিকই তবে নবাবের সৈন্যদের অবরুদ্ধ করে রাখে।ভাস্কর পণ্ডিত বর্ধমান রাজের প্রাসাদতূল্য রাজবাড়ি দখল করে সেখানে অবস্থান করে পার্শবর্তী স্থান গুলিতে ব্যাপক লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, খুন,রাহাজানি চালাতে থাকলো;সেই সাথে নবাবের সৈন্যদের বাইরেথেকে সমস্ত রকম খাদ্য সরাবরাহ ও যোগাযোগ বন্ধ করে রাখলো।গবেষকদেঁর তথ্য মতে সে সময় নবাবের সৈন্যদলকে সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর পর তিন দিন অভুক্ত অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল।অবস্থা বেগতিক দেখে নবাব নিজের সৈন্যদের অর্থ পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়ে উৎসাহিত করে মরিয়া হয়ে রণ সাজে সজ্জিত হয়ে বর্গীদের অবরোধ ভেদ করে ২২ এপ্রিল কাটোয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
         নবাবের সফর সঙ্গী ছিলেন বেগম শরফুন্নেশা।আলীবর্দি বেগম সহ মহিলাদের বর্ধমানে থেকেযেতে অনুরোধ করলেন,কিন্তু বর্গীদের ভয়ে কেউই থাকতে রাজি হলেন না।নবাবের সৈন্যদল বেগম শরফুন্নেসাকে ' লণ্ডা ' নামের এক হস্তিনীর পিঠে চড়িয়ে নিরাপত্তায় ঘিরে নিয়ে যেতে থাকলেন।কিন্তু সেদিন আকাশের মুখ ছিল ভার,তুমুল বৃষ্টিপাতের জন্য নবাবের সৈন্যরা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়লেন,আর তা বর্গী দস্যুদের যেন বাড়তি সুবিধা এনে দিল।তখন গলসির সাটিনন্দী গ্রামের নিকট ফাঁকা মাঠে শিবির গড়েছিল বর্গীরা।তালিত গ্রামের নিকট নবাবের সৈন্য পৌঁছালে অতর্কিত আক্রমনে নবাব সৈন্যরা পিছু হটে,আবার বর্ধমানে ফিরে আসার পথও বর্গীরা বন্ধ করে দিল;শুধু তাই নয়,নবাব সৈন্যদের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে বেগম কে বন্দী করে ফেলতে উদ্যত হয়।
    কাহিনীর এই ঘটনাক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিতে উপস্থিত হন তালিত রেলগেট পার হয়ে শিউড়ি রোডের ধারে আলমপুর গ্রামের নিকট যে প্রাচীন পীরের মাজার আজও এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় পীরের মাজার সেই হজরত মুশাপীর। হজরত মুশা ছিলেন নবাবের সেনাধ্যক্ষ উমর খানের পুত্র,প্রকৃত নাম মুশাহেব খান।মুশাহেব খান শুধু একজন যোদ্ধাই ছিলেন না,তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক জগতের ব্যক্তি।দুর্বল এক নারী অপহৃত হতে যাচ্ছে দেখে তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না,বীর বিক্রমে অস্ত্রহস্তে যুদ্ধ করে তিনি দস্যু বর্গী সেনাদের ছত্র ভঙ্গ করে ফেললেন,নবাব বেগমকে উদ্ধার করলেন।কিন্তু তালিতের সেই যুদ্ধে মুশাহেব খান বরণ করলেন শহীদের মৃত্যু।
             মুশাহেব খানের আধ্যাত্মীক জ্ঞান ও আত্মবিসর্জনের মাহাত্ম স্থানীয় জনমানসে তাঁকে পীরের মর্যাদা দিয়েছে।প্রতি বছর ২১ শে পৌষ এই মুশাপীরের উরস উপলক্ষে এক বিরাট মেলা বসে,হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলের কাছে তাঁর মাজার পবিত্রতা ও শ্রদ্ধার স্থান। এই পীর সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে অনেক কেরামতি বা অলৌকিক ঘটনার কাহিনী।জনশ্রুতি তালিতের যুদ্ধে বর্গীদের সাথে যুদ্ধে মুশাহেব খানের দেহ থেকে মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন হয়েগিয়েছিল,শিউড়ি রোডের ধারে যেখানে বর্তমান মাজার অবস্থিত তার বিপরীত দিকে মাঠে যুদ্ধস্থলে আরো অনেক সৈনিকের মুণ্ডুবিহীন দেহের সাথে মুসাহেব খানের ক্ষত বিক্ষত দেহও পড়েছিল;কিন্তু কোন দেহটা মুসাহেব খানের তা চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছিল না।এ দিবে নবাব আলীবর্দি বিশ্বস্ত এই সৈন্যের দেহ যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করতে না পড়ায় বিচলিত হয়ে পড়লেন,রাত্রে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যুদ্ধক্ষেত্রে পড়েথাকা অসংখ্য মুণ্ডুহীন দেহের মধ্যে এক দেহের উপর ফুল দেওয়া,সঙ্গে সঙ্গে রাত্রিতেই তিনি ঘুম থেকে উঠে অনুচরদের সাথে নিয়ে পৌছালেন যুদ্ধের মাঠে,দেখলেন সত্যিই তাই,এক মুণ্ডুহীন দেহের উপর ফুল রাখা।মুশাপীরের পবিত্র দেহ নবাব আলীবর্দির তত্তাবধানে সমাধিস্ত করা হলো।
             কিন্তু দুঃখের বিষয় কালের নিয়মে যেন হাড়িয়ে যেতে বসেছে বর্ধমানের অতীত ইতিহাসের গৌরবময় এই অধ্যায় গুলি।যে কটি গড়ের ঢিবি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই তার মাটি কেটে সমতল করেনিয়ে অচিরেই চাষ যোগ্য জমিতে পরিণত হবে।আমরা জানিনা তালিত গড়ের ইতিহাস,রাজা চিত্রসেনের অসহায়তার কথা,বর্ধমানের তৎকালী প্রজা সাধারণের প্রতি বর্গী দস্যুদের অত্যাচারের করুণ কাহিণী বা পীর হজরত মুশার প্রকৃত মাহাত্ম!হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর জানতেই পারবেনা এগুলির ঐতিহ্যকে।সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই জন্যই বাঙালীর ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন,সে আক্ষেপ আজো যেন আমাদের রইয়ে গেছে।
         ----------

তালত গড়ের ঢিবি
গড়ের প্রবেশপথ,নিশ্চিহ্ন হওয়ার অপেক্ষায়


হজরত মুশাপীরের মাজারের প্রবেশপথ
মুশাপীরের মূল মাজার
নবাবহাট থেকে উত্তরে শিউড়ি রোডের ধারে আলমপুরের নিকট হজরত মুশাপীরের মাজার

মাজারের পশ্চিমদিকে রাস্তার ওপাড়ে এই মাঠেই যুদ্ধে হজরত মুশাপীর শহীদ হয়েছিলেন,শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুণ্ডু এখানেই পায়াগিয়েছিল বলে শুনলাম,স্থানটি ভক্তদের কাছে শ্রদ্ধার।

বিঃদ্রঃ এই মাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রাম জনুড়া আমার মামার বাড়ি,ছোট থেকেই নানি ও মায়ের সাথে এই মাজারে অনেকবার এসেছি,আজ এই মাজারের মাহাত্ম আমার কাছে যেন নতুন ভাবে উন্মোচিত হলো।
ফিরোজ আলি কাঞ্চন
(এই লেখা ও ছবি অন্যকোথাও প্রকাশ বা কপি করা নিষিদ্ধ, সেয়ার করতে পারেন) 


      গড়ের  ঢিবি, তালিতের পীর হজরত মুশা ও বর্ধমানে বর্গী
        
                ফিরোজ আলী কাঞ্চন


রাঢ় বঙ্গের মধ্যমণী বর্ধমান জেলা এক প্রাচীণ জনপদ।জৈন আচারঙ্গ সূত্রে 'সুহ্মভূমি ',বাঁশঘেরার হর্ষবর্ধনের লিপিতে ' বর্ধমানকোটি ',গলসি অঞ্চলের মল্লসারুল গ্রামে জারুল নামক এক পুকুরে পঙ্ক উদ্ধারের সময় পাওয়া বঙ্গদেশের প্রাচীনতম তাম্রপট্ট লিপিতে ' বর্ধমানভুক্তি ' সহ বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বর্ধমানের উল্লেখ পাওয়া যায়।বর্ধমান জেলার ঐতিহ্যেএকদিকে যেমন আছে রাঢ় বঙ্গীয় বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি ও লোক বিশ্বাসের বিভিন্ন উপাদান,তেমনি আবার সেই প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী বর্ধমান জেলার মাটি।এখানের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান ঢিবি গুলি থেকে আবিস্কৃত নিদর্শন গুলি যেমন জেলার প্রত্ন তাত্বিক ঐতিহ্যর গুরুত্বকে প্রমাণিত করে তেমনি আবার বিভিন্ন স্থানের একাধিক ' গড়  'গুলি গড়েউঠার নেপথ্যেও রয়েছে  ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ।

বর্ধমান নবাবহাটের নিকট গ্রাম গড় বা গড় তালিত।গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে শান্ত নিরিবিলি নির্জন এক স্থানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রয়েছে অনেকগুলি ছোট ছোট ঢিবি।নিদৃষ্ট দূরত্বে গোলাকার ভাবে ঢিবি গুলি উঁচু বাঁধ দিয়ে পরস্পর  সংযুক্ত।বাঁধের বাইরের দিকে আবার পরিখা খনন করা,আকাশ পথ থেকে দেখলে অনেকটা ঘোড়ার নালের মতো,অপূর্ব তার সৌন্দর্য। একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই অনুমেয় শত্রু বাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই এমন নিরাপত্তা বেষ্টনীর নির্মাণ।
         উদাশীনতা আর অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে ঢিবি গুলি,ঢিবি ও বাঁধ কেটে চাষের জমিতে পরিণত হচ্ছে,পরিখা গুলিও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে বাঁধদিয়ে ছোট ছোট পুকুর এখন; তবুও নীরবে ঐতিহ্য আর বর্ধমানের ইতিহাসের মূক সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে রয়েছে তালিত গড়ের বেশ কয়েকটি ঢিবি।
          তালিত গড়ে ঢিবির সংখ্যা ছিল মোট ষোল টি,প্রত্যেক ঢিবিতে ছিল একটি করে কামান,কামান গুলিতে পারসি ভাষায় খোদিত ছিল বর্ধমানরাজ চিত্র সেনের নাম।চিত্রসেন নির্মিত আরো এমন একাধিক ঢিবির সন্ধান পাওয়া যায় রাজগড়, পানাগড়,সেন পাহাড়ী,এবং কাউগাছি বা কোগাছিতে।কাহিনীর অতীত সূত্রধরে এ প্রসজ্ঞে একের পর এক চলে আসে বর্ধমানে বর্গী আক্রমণ, চিত্রসেনের গড় নির্মান ও ভীত হয়ে আগেথেকেই বর্ধমান ছেড়ে পলায়ণ,নবাব আলীবর্দি খাঁ য়ের বর্ধমান আগমণ ও নবাব বেগম কে বর্গীদের অপহরণ,সেই সূত্রে নবাব বেগমকে  উদ্ধার করতে গিয়ে তালিতের পীর হজরত মুসার আত্মবিসর্জনের ঘটনা গুলি। 

১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে কীর্তিচাঁদের মৃত্যু পর তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী চিত্রসেন রায় বর্ধমানের জমিদারী লাভ করলেন,উল্লেখ্য এই চিত্রসেনই সর্ব প্রথম  দিল্লীর মুঘল সম্রাটের নিকট হতে ' রাজা ' উপাধির অধিকারী হয়ে চাকলে বর্ধমান সরকার সলিমাবাদের সত্বাধিকারী প্রাপ্ত হন এবং নাজরানা আদায় করার অনুমতি পান।মাত্র চার বছর রাজত্ব কালে চিত্রসেনকে মোকাবিলা করতে হয়েছি বাংলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখাত ভয়ংকর বর্গী বাহিনীকে।সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার রচিত ' চিত্রচম্পু ' কাব্যে চিত্রসেনের চরিত কথার বর্ণনা পাওয়া যায়।
    সম্রাট মহম্মদ শাহের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব বাংলায় বর্গী আক্রমণের মূল কারণ,আলিবর্দি  খাঁকে একদিকে যেমন তিনি সুবে বাংলার সুবাদারী প্রদান করেছিলেন,আবার অন্যদিকে বালাজিরাওকে চৌথ আদায়ের দায়ীত্ব দিয়েছিলেন।ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আলিবর্দি খায়ের সঙ্গে মারাঠাদের বিরোধ অনিবার্য হয়েউঠে।আর এই বিরোধে বর্গীদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েউঠে সমগ্র বর্ধমান জেলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা।গঙ্গারাম রচিত মহারাষ্ট্র পুরাণ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গের বর্ণনায় পাওয়াযায়-' তবে সব বরগি গ্রাম লুটিতে লাগিল/জত গ্রামের লোক সব পালাইল।/ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পলায় পুঁথির ভার লইয়া/সোনার বাইনা পলায় কত নিক্তি হুড়পি লইয়া।/গন্ধ বণিক পলায় দোকান লইয়া জত/তামা পিতল লইয়া কাঁসারি পলায় কত।/শঙ্খ বণিক পলায় কয়াত লইয়া জত/চতুর্দিকে লোক পলায় কি বলিব কত।'
   ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাস, ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে কুড়িহাজার মারাঠা সৈন্য নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে বর্ধমানের অভিমুখে যাত্রা করে।চিত্রসেন আগেথেকেই তা অনুমান করেছিলেন,তাই বর্ধমানের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে রাজবাড়ির নিকটে তালিত গড়ও কাটিয়ে রেখেছিলেন।কিন্তু বর্গী দস্যুদের ক্ষীপ্রতা আর অত্যাচারের কাহিনী তিনি অবগত ছিলেন,তাই সাহসে কুলালো না,তিনি পরিবার ও বিশ্বস্ত মন্ত্রী মানিকচাঁদকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন মুর্শিদাবাদে।
           এদিকে আবার নবাব আলীবর্দি খাঁ উড়িষ্যার বিদ্রোহ দমন করে ফিরে আসার পথে বর্ধমানে পৌঁছে রাণিসায়েরের পাড়ে শিবির ফেললেন।কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রবেশ করে দস্যু বর্গী বাহিনী ১৫ এপ্রিল একেবারে নবাবের সৈন্যদের উপর হামলা চালায়।এতে নবাবের তাবু পর্যন্ত বর্গীরা পৌছাতে পারেনা ঠিকই তবে নবাবের সৈন্যদের অবরুদ্ধ করে রাখে।ভাস্কর পণ্ডিত বর্ধমান রাজের প্রাসাদতূল্য রাজবাড়ি দখল করে সেখানে অবস্থান করে পার্শবর্তী স্থান গুলিতে ব্যাপক লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, খুন,রাহাজানি চালাতে থাকলো;সেই সাথে নবাবের সৈন্যদের বাইরেথেকে সমস্ত রকম খাদ্য সরাবরাহ ও যোগাযোগ বন্ধ করে রাখলো।গবেষকদেঁর তথ্য মতে সে সময় নবাবের সৈন্যদলকে সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর পর তিন দিন অভুক্ত অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল।অবস্থা বেগতিক দেখে নবাব নিজের সৈন্যদের অর্থ পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়ে উৎসাহিত করে মরিয়া হয়ে রণ সাজে সজ্জিত হয়ে বর্গীদের অবরোধ ভেদ করে ২২ এপ্রিল কাটোয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
         নবাবের সফর সঙ্গী ছিলেন বেগম শরফুন্নেশা।আলীবর্দি বেগম সহ মহিলাদের বর্ধমানে থেকেযেতে অনুরোধ করলেন,কিন্তু বর্গীদের ভয়ে কেউই থাকতে রাজি হলেন না।নবাবের সৈন্যদল বেগম শরফুন্নেসাকে ' লণ্ডা ' নামের এক হস্তিনীর পিঠে চড়িয়ে নিরাপত্তায় ঘিরে নিয়ে যেতে থাকলেন।কিন্তু সেদিন আকাশের মুখ ছিল ভার,তুমুল বৃষ্টিপাতের জন্য নবাবের সৈন্যরা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়লেন,আর তা বর্গী দস্যুদের যেন বাড়তি সুবিধা এনে দিল।তখন গলসির সাটিনন্দী গ্রামের নিকট ফাঁকা মাঠে শিবির গড়েছিল বর্গীরা।তালিত গ্রামের নিকট নবাবের সৈন্য পৌঁছালে অতর্কিত আক্রমনে নবাব সৈন্যরা পিছু হটে,আবার বর্ধমানে ফিরে আসার পথও বর্গীরা বন্ধ করে দিল;শুধু তাই নয়,নবাব সৈন্যদের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে বেগম কে বন্দী করে ফেলতে উদ্যত হয়।
    কাহিনীর এই ঘটনাক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিতে উপস্থিত হন তালিত রেলগেট পার হয়ে শিউড়ি রোডের ধারে আলমপুর গ্রামের নিকট যে প্রাচীন পীরের মাজার আজও এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় পীরের মাজার সেই হজরত মুশাপীর। হজরত মুশা ছিলেন নবাবের সেনাধ্যক্ষ উমর খানের পুত্র,প্রকৃত নাম মুশাহেব খান।মুশাহেব খান শুধু একজন যোদ্ধাই ছিলেন না,তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক জগতের ব্যক্তি।দুর্বল এক নারী অপহৃত হতে যাচ্ছে দেখে তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না,বীর বিক্রমে অস্ত্রহস্তে যুদ্ধ করে তিনি দস্যু বর্গী সেনাদের ছত্র ভঙ্গ করে ফেললেন,নবাব বেগমকে উদ্ধার করলেন।কিন্তু তালিতের সেই যুদ্ধে মুশাহেব খান বরণ করলেন শহীদের মৃত্যু।
             মুশাহেব খানের আধ্যাত্মীক জ্ঞান ও আত্মবিসর্জনের মাহাত্ম স্থানীয় জনমানসে তাঁকে পীরের মর্যাদা দিয়েছে।প্রতি বছর ২১ শে পৌষ এই মুশাপীরের উরস উপলক্ষে এক বিরাট মেলা বসে,হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলের কাছে তাঁর মাজার পবিত্রতা ও শ্রদ্ধার স্থান। এই পীর সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে অনেক কেরামতি বা অলৌকিক ঘটনার কাহিনী।জনশ্রুতি তালিতের যুদ্ধে বর্গীদের সাথে যুদ্ধে মুশাহেব খানের দেহ থেকে মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন হয়েগিয়েছিল,শিউড়ি রোডের ধারে যেখানে বর্তমান মাজার অবস্থিত তার বিপরীত দিকে মাঠে যুদ্ধস্থলে আরো অনেক সৈনিকের মুণ্ডুবিহীন দেহের সাথে মুসাহেব খানের ক্ষত বিক্ষত দেহও পড়েছিল;কিন্তু কোন দেহটা মুসাহেব খানের তা চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছিল না।এ দিবে নবাব আলীবর্দি বিশ্বস্ত এই সৈন্যের দেহ যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করতে না পড়ায় বিচলিত হয়ে পড়লেন,রাত্রে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যুদ্ধক্ষেত্রে পড়েথাকা অসংখ্য মুণ্ডুহীন দেহের মধ্যে এক দেহের উপর ফুল দেওয়া,সঙ্গে সঙ্গে রাত্রিতেই তিনি ঘুম থেকে উঠে অনুচরদের সাথে নিয়ে পৌছালেন যুদ্ধের মাঠে,দেখলেন সত্যিই তাই,এক মুণ্ডুহীন দেহের উপর ফুল রাখা।মুশাপীরের পবিত্র দেহ নবাব আলীবর্দির তত্তাবধানে সমাধিস্ত করা হলো।
             কিন্তু দুঃখের বিষয় কালের নিয়মে যেন হাড়িয়ে যেতে বসেছে বর্ধমানের অতীত ইতিহাসের গৌরবময় এই অধ্যায় গুলি।যে কটি গড়ের ঢিবি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই তার মাটি কেটে সমতল করেনিয়ে অচিরেই চাষ যোগ্য জমিতে পরিণত হবে।আমরা জানিনা তালিত গড়ের ইতিহাস,রাজা চিত্রসেনের অসহায়তার কথা,বর্ধমানের তৎকালী প্রজা সাধারণের প্রতি বর্গী দস্যুদের অত্যাচারের করুণ কাহিণী বা পীর হজরত মুশার প্রকৃত মাহাত্ম!হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর জানতেই পারবেনা এগুলির ঐতিহ্যকে।সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই জন্যই বাঙালীর ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন,সে আক্ষেপ আজো যেন আমাদের রইয়ে গেছে।
         ----------











Sunday, September 8, 2019



শোকের আবহে শান্তির বার্তায় মহরম

                          ফিরোজ আলী কাঞ্চন


মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মূলত কোন বিভাগ না থাকলেও হজরত মহম্মদের(সাঃ)পরলোক গমনের পর ইসলাম ধর্ম সুন্নী ও শিয়া এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।সুন্নীর অর্থ সুন্নতের অধিকারী,যাঁরা নবিজীর নীতি ও আদর্শ অনুসরণ  করে তাঁরাই সুন্নী।বাংলার তথা ভারত বা পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ মুসলমানই সুন্নী মতাবলম্বী।আর শিয়া শব্দের অর্থ দল।হজরত মহম্মদের(সাঃ) ইন্তেকালের পর খলিফা কে হবেন এই নিয়ে বিতর্ক দেখাযায়,নবিজীর জামাতা হজরত আলিকে  খলিফা হিসেবে সমর্থন করে শিয়া দলের উৎপত্তি।ইরাক,ইরান শিয়া অধ্যুষিত দেশ,ভারতের মুসলিমরা সুন্নি প্রাধান্য হলেও কিছু সংখ্যক শিয়া মতাবাদী মুসলিমও রয়েছে,হায়দ্রাবাদের সুলতান টিপুর বংশ,জিন্নাহ,বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা প্রমুখগণ শিয়া ছিলেন।
     
   শিয়া ও সুন্নী উভয় মতাবলম্বী গণের কাছেই মহরমের গুরুত্ব অপরিসীম।পবিত্র কোরান অনুসারে আরবি বারোটি মাসের মধ্যে যে চারটি মাস আল্লাহ তলার কাছে সবচেয়ে সম্মানিত তার মধ্যে অন্যতম মহরম মাস।'মহরম ' প্রকৃতপক্ষে একটি মাসের নাম,তবে শিয়া ও সুন্নীদের কাছে এমাসের গুরত্ব আলাদা আলাদা।সুন্নীরা এ মাসে রোজা রাখে,দান-খয়রাত করে থাকে,অপরদিকে শিয়ারা রোজা রাখা বা দান খয়রাতের সাথে সাথে মহরমে তাজিয়া,লাঠিখেলা,মর্সিয়া গাওয়া ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেথাকে,যা সুন্নীরা পছন্দ করেন না।স্বাভাবিক ভাবে সচেতন পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেপারে আমাদের এখানের মুসলিমরা সুন্নী হয়েও মহরমে তাজিয়া বেরকরে, মর্ছিয়া গায় বা লাঠিখেলে কেন?আসলে এখানেই লুকায়িত আছে বাংলার সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারাটি,যা সকলকে আপন করে নেওয়ার।বাঙলায় ইসলামের আগমন ঘটেছে মূলত ইরান পারস্য হতে আগত পীর ওলী আউলিয়াদের মাধ্যমে,আর এই পীর আউলিয়ারা বাংলায় এসে এখানের সংস্কৃতির সজ্ঞে যেন মিশে গিয়েছিলেন।এ প্রসঙ্গে বলতে হয় মঙ্গলকোটের পীর হামিদ বাঙালীর কথা,সম্রাট শাহজাহানের আধ্যাত্মীক এই গুরু সুদূর পারস্য থেকে  এসে মঙ্গলকোটে আস্তানা গড়েছিলেন।প্রকৃত নাম ছিল হামিদ দানেশাখন্দ,কিন্তু তিনি ক্রমে বাংলাকে ভালোবেসে,বাংলার মাটি জল হাওয়ার সাথে গভীর একাত্মতাবোধে নিজেকে ' বাঙালী ' পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করতেন।তাইতো এইসব মহান ওলী আউলিয়াদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম এদেশে এসে হয়েউঠেছিল অনেক উদার।এখানের মুসলিমরা একদিকে যেমন শিয়া ও সুন্নীর সমন্বয় সাধন ঘটিয়েছে,তেমনি আবার বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যের ধারাকেও বজায়রেখেছে।আর নবিজীর আদর্শ ছিল এটাই,তিনি আরবের পূর্ব বর্তী সমস্ত জনজাতিকে নিয়ে এক অখণ্ড মানবতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, হজরত মহম্মদ (সাঃ) আমাদের দেশে আসতে পারেননি কিন্তু আরব,ইরান,পারস্যথেকে এই পীর আউলিয়াগণ সেই মানবতার বাণীই এখানে এনে যেন পৌছে দিলেন,সেই সূত্র ধরেই সুন্নী প্রধান এদেশেও মহরম মানে রোজা,দান ধ্যানের পাশাপাশি ' হায় -হোসেন, হায় -হোসেন 'প্রলাপে বুকফাটা ক্রন্দন।

'মহরম ' আরবি শব্দ,এর অর্থ পবিত্র বা সম্মানিত।ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাসের নাম মহরম।বিশ্বাস অনুযায়ী এ মাসে পরম প্রভু আল্লাহতালা এই বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন,এই মাসে আদি পিতা হজরত আদম কে সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই মাসেই স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে পৃথিবীতে পতিত হয়ে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর   আদিপিতা আদম ও মা হাওয়া পরস্পরকে দেখাপেয়েছিলেন;এছাড়া আরো একাধিক ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ৬১হিজরী ১০ই মহরম- আশুরার দিন কারবালার প্রান্তরে এজিদ বাহিনীর হাতে ইমাম হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যুর কাহিনী;এই বিষাদ গাঁথাকে স্মরণ করে মুসলিম সমাজ পরম ভক্তিভরে পালন করে থাকে শোকের পরব মহরম।
       মহরমের দিন রোজা রাখা হয়,গরিব মিসকিনদের বিতরন করা হয় চালের আটার পিঠে,হালুয়া সুজি,কোথাও পথিকদের জল পান করানো হয়,কোথাও বেরকরা হয় তাজিয়া,লাঠি খেলা হয়,মর্সিয়া গাওয়া হয়।হাসান,হোসেনের করুণ গাঁথাকে গাইতে থাকে মূল গায়ক আর বাকীরা বুক চাপড়ে বলতে থাকে ' হায় হোসেন,হায় হায়!!'।অনেকে আবার হাতের আঙুলের মাঝে রাখে ব্লেট আবার অনেকে পিঠি মারতে থাকে খঞ্জর। 
  কারবালার এই হৃদয়বিদারক কাহিনি অবলম্বনে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ' মহরম' কবিতা-"মহরম ! কারবালা ! কাঁদো হায় হোসেনা ! / দেখো  মরু - সূর্য এ খুন যেন শোষে না।"কবিতাটি ' মোসলেম ভারত ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।মহরমের মর্সিয়ার করুন সুর যেন হৃদয় কে স্পর্শ করে।'মর্সিয়া' আরবি শব্দ,যার অর্থ শোক পেকাশ।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অনেক কবি ফারসি ও উর্দু মর্সিয়ার ভাবধারা অবলম্বনে বাংলা মর্সিয়া রচনা করে নিজস্ব স্বতন্ত্রতার পরিচয় দিয়েছেন,এঁদের মধ্যে হামিদুল্লাহ,মোহম্মদ খান,শাহ গরীবুল্লাহ,হিন্দু কবি রাধামোহন গোপ,মীর মোশাররফ হোসেন,হামিদ আলী,কায়কোবাদ,শেখ ফয়জুল্লা প্রমুখগণ উল্লেখ্যোগ্য।

       পূর্বেই বলা হয়েছে মুসলিম সমাজের আবার একটা অংশ এই লাঠি খেলা,তাজিয়া বেরকরা,মর্সিয়া গাওয়া বা খঞ্জর চালানোর বিরোধী,আর এক পক্ষ্য বলে মর্সিয়া গেয়ে,লাঠি খেলে,ধারালো খঞ্জরের আঘাতে রক্ত ঝরিয়ে যেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার সজ্ঞে নিজেদের একাত্মতা অনুভূত হয়েথাকে।ধু ধু মরু প্রান্তরে হোসেন পুত্র আলী আসগর একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করতে থাকে,পিতার কাছে কচি সেই প্রাণ আধো আধো স্বরে বলতে থাকে ' আল-আৎশ!', ' আল-আৎশ!! ' অর্থাৎ পিপাসা,পিপাসা।চারিদিকে শত্রু সৈন্যে আবদ্ধ হোসেন নিজের জিহ্বা পুত্রের মুখে পুরে দিলেন,কিন্তু তাতে কি আর গলা ভিজে?দুধের শিশুকে কোলে তুলে হোসেন বাইরে বেড়িয়ে শত্রু সৈন্যদের কাছে শুধু পুত্রের জন্য একটু জলের প্রার্থনা জানালেন,বিনিময়ে ছুটে এলো তীর,বিদ্ধ আসগর কে ফিরিয়ে নিয়ে এসে হোসেন স্ত্রীর কোলে তুলে দিয়ে বললেন,'এই নাও তোমার পুত্র,ওর সারা জীবনের মতো তৃষ্টা মিটে গেছে,ও আর কোনদিন পিপাসা পিপাসা বলবে না।'এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া সাখাওত হোসেন লিখেছেন," এই যে মহরমের নিশান,তাজিয়া প্রভৃতি দেখা যায়,ঢাক ঢোল বাজে,লোকে ছুটাছুটি করে,ইহাই কি মহরম?...আচ্ছা তাহাই হউক;ঐ নিশান তাজিয়া লইয়া খেলাই হউক; কিন্তু ঐ দৃশ্য কি একটা পুরাতন শোক স্মৃতি জাগাইয়া দেয় না?বায়ু হিল্লোলে নিশানের কাপড় আন্দোলিত হইলে তাহাতে কি স্পষ্ট লেখা দেখা যায় না- 'পিপাসা '? "
           বর্ধমান জেলার  আসানসোল, বার্ণপুর,রাণীগঞ্জ,জামালপুর,কালনা,কাটোয়া,গলসির খেতুড়া,দয়ালপুর,দরবাপুর,বাহিরঘন্না সহ বিভিন্ন অঞ্চলে মহরমের তাজিয়া বের হয়ে থাকে,মূল বর্ধমান শহরে বি সি রোডে এক বিশাল শোক মিছিল বেড় হয়,কালাপাড়ি পীরের আস্তানা থেকে ঢাল বের হয়ে পুরো শহর পরিক্রমা করে। এ ছাড়াও পুরাতন চক, দুবরাজ দিঘী,ছোট নীল পুর,কুরমুন  চন্দনপুর, খাজা আনোয়ার বেড় এলাকা থেকেও ঢাল বের হয়ে থাকে।কয়েক বছর  আগে দূর্গাপুজো ও মহরম একই সময়ে পড়েছিল,গলসির চৌমাথার স্টার ক্লাবের পুজোমণ্ডপে খেতুড়া,বাহিরঘন্না গ্রামের ছেলেরা মহরমের মর্সিয়া গেয়ে এক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।আবার সে বছর পুজো ও মহরম এক সঙ্গে হওয়ায় ঢাক ঢোল বাজনা নিজেদের মধ্যে ভাগকরে নিয়েছিলেন ভাতারের এরুয়ার কাজীপাড়ার মহরম কমিটি ও স্থানীয় পুজো কমিটির সদস্যগণ।আউস গ্রাম অঞ্চলের সিলুট বসন্তপুর গ্রামে মহরমে নাটক,যাত্রা,কবিতা আবৃতি,গজল,কেরাতপাঠের আয়োজন করা হয়ে থাকে।কয়রাপুর গ্রামে  মহরমে বিশেষ কিছু রীতি পালন করা হয়,গ্রামের বাছায় দশ জন ব্যক্তি ব্রত পালন করে থাকে,মহরমের চাঁদ উঠার এক দিন পর এই দশজনে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে মজ্ঞল কোটে গিয়ে সেখানে আধ্যাত্মিক গুরু ছোট হুজুরের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে এসে মজ্ঞলকোটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পীর আউলিয়ার মাজার পরিক্রমা করে আবার অন্যপথে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরে এসে অবস্থান করে ইমামতলায়,এই ইমাম তলা হলো হাসান হোসেনের কল্পিত মাজার,এই কয়েকদিন ১০ই মহরম পর্যন্ত এই পালনকারীদের বাড়ির সজ্ঞে কোন সম্পর্ক থাকে না,এরা রোজারেখে থাকে,চুল, দাড়ি,নখ কাটা এই সময় গুলিতে নিষিদ্ধ;মহরমের দিন জ্বলন্ত আজ্ঞারের উপর  দিয়ে হেটে আগুন মাতম করা হয়ে থাকে।অনেক মুসলিম প্রধান গ্রামে আছে ইমামতলা,মহরম শেষে তাজিয়া এনে ইমাম তলায় রাখাহয়।

 এভাবে শোকের আবহে ধর্মীয় আধ্যাত্মীকতার সাথে সাথে শান্তির দৃষ্টান্ত রেখেছে মহরম।
                          ---






Tuesday, September 3, 2019

হাজড়াডাঙ্গা ঢিবি থেকে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ







রাঢ়বঙ্গের মধ্যমণি বর্ধমান জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিকবার আবিস্কৃত হয়েছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন।সেই প্রস্তর যুগ হতে বিভিন্ন সময়ে বসবাসকারী মানব গোষ্ঠীর জীবন যাত্রার বিবর্তনের ধারার একাধিক নিদর্শন আমাদের  বর্ধমান জেলায় পাওয়া গেছে।আউসগ্রাম অঞ্চলের সিলুট বসন্তপুরে হাজড়া ডাঙা হতে পাওয়া এই প্রান্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলি যেন সেই ধারায় নতুন এক অধ্যায় যোগ করলো।















এর আগে এই আউসগ্রাম অঞ্চলে পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে খনন কার্য চালিয়ে আবিস্কৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন গুলিথেকে প্রমাণিত হয়েছে যে পাণ্ডুরাজার ঢিবি অঞ্চলের সভ্যতা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরানো।







আমার বাড়ি যদিও গলসি অঞ্চলে,এর আগে আমাদের ওখানে খানোগ্রামে বাঘারাজার ঢিবি হতে বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহ করে আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম।এই সিলুট বসন্তপুরের আমার এক আত্মীয়র কাছথেকে জানলাম এখানে হাজড়া ডাঙায় কবরস্থানে মাটি কাটতে গিয়ে বিভিন্ন মাটির পাত্রের ভগ্ন অংশ বেড়িয়ে আসে।কৌতুহলী হয়েএসে দেখলাম খানোর বাঘারাজার ঢিবি হতে প্রাপ্ত নিদর্শন গুলির সঙ্গে এগুলির সাদৃশ্য রয়েছে।অনুমান করাযেতে পারে কালো,ধূসর, লাল বর্ণের এই মাটির পাত্রগুলি তাম্রশ্মীয় যুগের।
    হাজড়া ডাঙার কিছুটা অংশ গোরস্থান রুপে ব্যবহার  করাহয়,বাকী অংশ খেলার মাঠ।অবশ্যই এখানে ছিল প্রাচীন সভ্যতা,খেলার মাঠে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খনন কার্যচালালে আরো অনেক কিছুই পাওয়াযেতে পারে।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র বাঙালীর ইতিহাস নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন।সেই আক্ষেই যেন আমাদের আজো রয়েগেল।

ফিরোজ আলী কাঞ্চন
শিক্ষকঃজামালপুর থানার অন্তগর্ত টেরাপুর পল্লীমঙ্গল হাই মাদ্রাসা
গ্রামঃখেতুড়া,গলসি,বর্ধমান
9153735310