Wednesday, January 15, 2020

 লোক উৎসব টুসু
                   ফিরোজ আলি কাঞ্চন
ব্রাতজনের সংস্কৃতি হলো লোকসংস্কৃতি,লোক জীবনের কয়েক শত বা হাজার বছরের চর্চা ও চর্যার ফলে এক মার্জিত রুপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এখানে।এই লোক সংস্কৃতির নানা রুপ ও নানা আঙ্গিক,তবে রাঢ় বঙ্গে তথা দক্ষিণ বঙ্গে এর প্রধান-অপ্রধান অঙ্গ উপাঙ্গ গুলি সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও বৈশিষ্ট্যময়। এখানে ধর্ম ঠাকুর,শীতলা,,মনসা প্রভৃতি লৌকিক দেব দেবী থান ও পুজার প্রচলন যেমন দেখা  যায় তেমনি পাওয়া যায় বাউল গান,কবি গান,লোটো,পঞ্চরস,ভাদ্র মাসে ভাদু আর পৌষ মাসে টুসু গান ইত্যাদি বহুবিধ লোক ঐতিহ্যের সন্ধান। 






                              টুসু লোক উৎসব,রাঢ বজ্ঞেপ্রাণের উৎসব।অখণ্ড বর্ধমান,বাঁকুড়া,পুরুলিয়া, মানভূম,সিংভূম অঞ্চলে বাউড়ি,মেটে,ক্ষেত্রপাল,মাহাতো,কুর্মি,মুণ্ডা,সাঁওতাল,ভূমিজ ইত্যাদি দ্রাবিড় অষ্ট্রিক ভাষা বর্গের মধ্যে ব্যাপকভাবে পূজিত হন এই অবৈদিক,অপৌরাণিক লোক দেবী।এমনকি ওপার বাংলার রাজসাহীতে রাজোয়াড় সম্প্রদায়ের মধ্যেও টুসু পরবের প্রচলন দেখাযায়।টুসু শব্দের নামকরণ কিভাবে হলো তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের বিভিন্ন মত।অনেকে মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যের প্রজননের দেবতা টেষুর নাম থেকে এসেছে টুসু,এদের মতে টুসু কুমারী নারীদের উপাস্য প্রজননের দেবী,আবার অনেকে বলেন ধানের 'তুষ' থেকে টুসু শব্দটি এসেছে,এদের মতে টুসু শস্য দেবী,আবার অনেক গবেষক মনে করেন তিষ্যা বা পুষ্যা নক্ষত্র থেকে টুসু নাম হয়েছে।
          শীতের আমেজে যখন  মুখরিত সারা বাংলা,তারই মধ্যে অঘ্রাহায়নের শেষদিন থেকে আরম্ভ এই উৎসবের।এই দিন মাঠ থেকে নতুন ধানের একটা গোছা মাথায় করে আনেন পাড়ার মেয়েরা,সন্ধ্যা হলে কুমারী মেয়েদের দল তুষের উপর রাখে আলো চাল,দূবা' ঘাস,সরষে,বাসক, আকন্দ প্রভৃতি ফুল।তার পর পাত্রটিকে হলুদ টিপ পড়িয়ে পিঁড়ির উপর  রেখে শুরু  হয় প্রতিদিনের সন্ধ্যা পূজা। পাড়ার কুমারী মেয়েরা রোজ সন্ধযায় একসজ্ঞে টুসু গান গেয়ে তাদের নিজস্ব সুখ দুখের প্রকাশ ঘটায়।পৌষ মমাসের শেষ চার দিনের প্রথম দিনকে বলা হয়ে থাকে চাউড়ি,এদিন বাড়িতে বাড়িতে তৈরী হয় চালগুড়ি,বাড়ির মেয়েরা গোবর মাটি দিয়ে উঠোন নিকায়,দ্বিতীয়  দিন বাঁউড়ি,এদিন বাড়িতে তৌরী হয় বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন রকমের পিঠে,এদিনের রাত জাগরনের রাত,সব বাড়ি আলোর সাজে সেজে উঠে,পাড়ার সব মেয়ের দল সারা রাত ধরে টুসুগান গায়।
             টুসু উৎসবের মূল আকর্ষন তার গানগুলি,গানের ভাষা যেমন সহজ সরল তেমনি প্রানবন্ত,গানগুলির বিষয় তাদের লোক জীবন থেকে উঠে আসা প্রতিদিনের হাসি কান্না,ব্যাথা বেদনা,সংসারের বিভিন্ন অনুভূতি,মেয়েলি বিবাদ,প্রভৃতি;শুধু তাই নয় নারী নিযা'তন,জাত পাত,কুসংস্কার প্রভৃতি সামাজিক সমস্যার কথাও এর বিষয়ে প্রবেশ করে থাকে।
                 শেষে পৌষসংক্রান্তির প্রত্যুষে টুসু দেবীকে সুসজ্জিত চর্তুদোলায় বসিয়ে গান গায়তে গায়তে নিয়ে গিয়ে নিকটস্থ নদী,দিঘী বা কোন পুকুরে দেওয়া হয় বিশর্জন।স্নান করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে মেয়েদের দল আবার গান গায়তে গায়তে ফিরে যায় গ্রামের পথে,এসময় এরা গানের মাধ্যমে এক দল অন্য দলকে আক্রমন করে_
                 "আমার টুসু নেয়ে এলো
                                   কি বা পড়তে দিবো গো?
                     ঘরে আছে বেনারসী
                                 তাই বার করে দিব গো।
                  ওদের টুসু নেয়ে এলো
                                    ওরা কিবা পড়তে দিবে গো?
                       ওদের ঘরে আছে ছিঁড়া ট্যানা
                                      ওরা তাই বার করে দিবে গো।
    
              টুসুগানে সমসাময়িক সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক ভাবনারও প্রতিফলন লক্ষ করার মতো।টুসু গানের প্রাণ কেন্দ্র পুরুলিয়াতো আগে বিহার প্রদেশের সজ্ঞে যুক্ত ছিল,একদিকে বাংলার অনাগ্রহ আর অন্যদিকে বিহার সরকারের লাঞ্ছনা, সে ব্যাথা ছিল পুরুলিয়ার একান্ত নিজস্ব।সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল পুরুলিয়াবাসী,আর তাদের প্রতিবাদের ভাষা জুগালো তাদের মাটির সৃষ্ট প্রাণের গান টুসু গান।ভজহরি মাহাতোর,যিনি ছিলেল দক্ষীন মানভূম সংসদীয় আসন থেকে প্রথম সাংসদ,লেখা টুসুগান  "শুন বিহারী ভাই তোরা রাইতে লারবি ডাং দেখাই..."হয়ে উঠল পুরুলিয়া বাসীর প্রতিবাদী স্লোগান,উত্তাল হয়ে উঠল সমগ্র মানভূম।বিহার সরকার চরম দমন মূলক নীতি গ্রহন করে,ভজহরি মাহাতোকে গ্রেপ্তার করে কোমরে দড়ি বেধে আদালতে তোলা হয়েছিল।
        কালের প্রভাবে টুসু উৎসব তার গৌরব যেন হারাতে বসেছে,অতি আধুনিকতার আগ্রাসনে এখন এই টুসু উৎসবে যতো না গান শোনা যায় তার চেয়ে বেশি সোনা যায় যন্ত্র দানবের কন্ঠে ডিজে র তীব্র হুংকার,নতুন করে গান ও আর বাঁধা হয় না,' টুসু আমার ভাত খাবে লো আলুপোস্ত তরকারী ' এমন ধারা সহজ সরল মনের কথা আর নতুন করে টুসু গানে প্রকাশ পায় না,তবুও আজও গলসি,বুদবুদ,আউসগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে টুসু গানের সুর যখন মকর সংক্রান্তির দিন গ্রামের মেঠো পথে সরষে ফুলের ক্ষেতের ওপার থেকে শীতের শীতল বাতাসে ভেষে আসতে শোনা যায়,তখন মনে হয়, না রাঢ় বঙ্গ এখনো তার বেশেষত্বকে হাড়িয়ে যেতে দেয়নি।
--------------------------------
ছবি ঃঃচন্দন চক্রবর্তী(পুরুলিয়া)
বিঃদ্রঃ এই লেখাটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত।এখানে কিছু পরিবর্তিত।অন্য কোথাও এ প্রবন্ধ মুদ্রন বা প্রকাশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ